মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১৭

যেতে হবে বহুদূর...

সবই তো দেখি হারিয়ে যায়, দেখছি- বাকি থাকেনা কিছু,
দিন যায়, মাস যায়, বছর-যুগের পর যায় কত যুগ।
প্রিয়া যায় প্রিয়া আসে, রয়ে যায় কেবল স্মৃতিরা চুপ,
স্বপ্ন ভাঙে, বিরহ পুড়ে, তবুও মানুষ কেন নেয় প্রেমের পিছু!!

প্রেমে বুঝি সুখ হায়! কত প্রাণ ঝরে যায়, হয়ে বেদনায বিদুর,
দ্বীন সংসার ভুলে, প্রিয়া নামের মালা গাঁথে, বুঝে না কভু দুখ।
ভালোবাসার কাঙাল হয়ে, প্রিয়া মনের আঙিনাতে-খুঁজে বেড়ায় সুখ,
স্বপ্নে সাজায় ঘর-বাড়ি, বাস্তবতার সাথে আঁড়ি, ভুলে আগামী সুদূর।।

সব সুখ, সব গান, হঠাৎ বুক শ্মশান, প্রিয়া হারায়ে কিশোর,
স্বপ্নের ভালোবাসা-নতুন সুখে হারায়, বেদনায় ভরে রাখে বুক।
লেখা নাই, পড়া নাই, বিরহের গান গায়, হয় ভালোবাসায় ক্ষোভ,
ঘৃণায় ভরে পৃথিবী, বিষাদে কেঁদে উঠে বুক, মন যেন হয় পশুর।।

কেন ভাই, কেন এত পুড়ছ? ভুলে যাও প্রিয়া বিরহ-বেদনার সুর,
নতুন খুঁজে দেখো, প্রকৃতির মতো হও, তোমাকে যে যেতে হবে বহুদূর।
ভালোবাসো দেশ-মানুষ, হইয়ো না রঙিন ফানুস, জীবন দেখো-কত সুমধুর,
পাবে তৃপ্তি, বাড়বে স্বাদ-দেখো সুপ্রভাত, বৃদ্ধ যুবক কিশোর।।

এসো, দেশের গান গাই, ভালোবাসি-বাংলা সাজাই, দেখি রংধনু,
বাংলার আকাশে, বাতাতে, প্রকৃতিতে মিশে যাই, খুঁজি মানুষের দুখ।
সামান্য সুখে, আভিজাত্যের লুভে যেন- কভু না হই উৎসুক,
ন্যায়কে ভালোবাসি-অন্যায় নাশিয়া, বুঝিয়ে দেই আমি নই ভিতু।।

সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৭

বড় ভুল করেছিলাম তোমায় ভালোবেসে...

নয়ন-১


আমি কোন লেখক নই। লেখালেখির অভ্যাসও নেই। হয়'তো ভাল পাঠকও নই। তবে বই পড়া গল্প পড়া একটা অভ্যাস আমার মধ্যে সবসময় লক্ষ্য করেছি। কোন অচেনা গল্প কিংবা চেনা কোন বিষয অথবা রূপকথা কোথাও নজরে পড়লে সেটা পড়তাম মনোযোগ সহকারেই। হ্যা, প্রায় ভাবতাম আমার নিজের জীবনের ঘটনা গুলো কোথাও লিখে রাখবো। এরজন্য অনেক সময় নতুন খাতা কিনতাম। কিন্তু দু'এক দিন লিখার পর আর সময় মনোযোগ কিছুই থাকতো না। তাই আর লিখা হয়নি আমার জীবন প্রবাহ। খাতা ফাঁকাই রয়ে যেতো।
তবে সামুতে রেজিস্ট্রেশন করার পর আবার সেই পুরোন ইচ্ছাটা নতুন করে কাজ করছে। কোনকিছু শুরু না করলে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নাই। তবে এবার ভাবছি লিখবো। ভাল গুছিয়ে না পারি। নিজের ব্লগে নিজের করেই রেখে দিবো না হয়।

সাধারণ পাঁচ দশজনের মতো আমিও অতি সাধারণ একজন। সঙ্গীত প্রিয় হাসি খুশি চঞ্চল প্রকতির স্বভাব থাকায় এলাকার প্রায় অনেকাংশ মানুষ বৈরাগী সম্বোধন করতো। আমি হয়তো খুশিই হতাম। আমি কিন্তু বৈরাগী শব্দের অর্থ জানতাম না। তবে বিরক্তিবোধো হতো না কখনো। আজ বুঝছি বৈরাগী জীবন কাকে বলে। হয়'তো মিল ছিল তাই হয়'তো অনেকেই বলেছে। যাক সেই বিষয় অনেক পরের বিষয়।
যার জীবন বৃত্তান্ত লিখছি তার পরিচয় আগে দেওয়া উচিৎ। 

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জেলা শেরপুর। অনেকেই গারো পাহাড় বলেও জানতো যদিও পাহাড় জেলার একপ্রান্তে। শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অস্থিত গজনী পাহাড়। যা 'গজনী অবকাশ' নামেই পরিচিত। 

শেরপুর সদর উপজেলার ২নং চরশেরপুর ইউনিয়ন চরশেরপুর গ্রামের শেষে শুরু সাতানীপাড়া গ্রামের। গ্রামে ঢুকে প্রথম যে বাড়িতেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এটিএম জিন্নাত আলী'র তিন ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় জনের নাম মো: নাঈম জাহাঙ্গীর 'নয়ন'। জন্ম ২৯ মার্চ ১৯৮২ইং সালে শেরপুর সদর উপজেলার ২নং চরশেরপুর ইউনিয়নের সাতানীপাড়া গ্রামে। গ্রামের মানুষ নয়ন নামেই জানতো, ডাকতো। হাস্যউজ্জল চঞ্চলতায় ভরা ছিল নয়নের বাল্য কিশোর সময়গুলি। হাসি তামাসা গান বাজনা নিয়েই মেতে থাকতো সবসময়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর খেলা ধূলায় কেটে যেতো দিনের পর দিন, মাস ,বছর।

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েও কোনোদিন দুঃখ কষ্ট তাদের তিন ভাইকে ছুতে পারেনি। সুখেই যাচ্ছিল কেটে নয়নের জীবন। পাশের গ্রামের হাইস্কুলে পড়তো নয়ন। লেখা পড়ায় মোটামুটি। পড়া লেখায় মনোযোগী কমই ছিল। তবে একেবারে খারাপ ছাত্র যে ছিল তা কিন্তু নয়। অষ্টম ক্লাসে যখন পড়ে তখন নয়নের বয়স মাত্র বারো বছর। শরীর স্বাস্থ্য ভালো তাই দেখতে বয়সের তুলনায় একটু বড়ই দেখা যেত।

হঠাৎ সেই স্কুলে একদিন নতুন এক সুন্দরী মেয়ে এসে ভর্তি হল। মেয়ে দেখতে শুনতে ভালোই পরীর লাহান ,কিন্তু পড়া লেখায় ছিল রূপ চেহারার পুরোপুরিভাবে বিপরীত। সেটা বুঝতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নি। ক্লাশ এইট থেকে নয়ন তৃতীয় রোল নিয়ে ক্লাস নাইনে উঠে। সেই সুন্দরীও কোনোরকম পাশ করে। দূর ! মেয়েটি মেয়েটি বলতে আর ভালো লাগছে না। এবার নামটাই বলে দেই। নাম ছাড়া কি আর চলে ! সত্যিই এই নামটি ছাড়া নয়নের একদিনও চলতে চাইতো না। ক্লাস নাইন থেকেই নয়নের লাইন শুরু মিনতি'র সাথে। সেই থেকেই নয়নের জীবনের ছন্দ পতনের শুরু ....

------------------------------------------------------#
দুনিয়ার সবাই কাউকে না কাউকে ভালোবাসে, ভালোবাসতে চায়, ভালোবেসে সাজাতে চায় নিজের ভবিষ্যৎ ঘর-সংসার। কিন্তু সবার পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠেনা সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যটি পূরণের। কেউ মাঝ পথে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। আবার কেউ বা জীবনের দীর্ঘপথ ভালোবেসে যেয়েও পথহারা হয়ে জীবনের যোগবিয়োগ কষে পায় শূন্য। সব ভালোবাসা, বিশ্বাস এক নিমিষে ভেঙ্গেচুরে চুরমার হয়ে যায়। নিঃস্ব হৃদয়ের বিষণ্ণতা আর ভালোবাসা হারানোর ব্যথায় পুড়তে হয় বহুদিন, বহুকাল হয়তো জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত। প্রিয়া বিরহের ব্যথিত মনের শেষ বাণী হয়ে বেরিয়ে আসে ‘বড় ভুল করেছিলাম তোমায় ভালোবেসে’ ।

নতুন জীবনের নতুন যৌবন প্রতিটি প্রাণীকুলকে ছন্দময় চঞ্চলা করে তুলে। নির্ভাবনা আর যৌবনারম্ভে মনের আকাশে ইচ্ছাগুলো দুরন্তপনা হয়ে উঠে। চোখের সামনে সবকিছুই তখন রঙ্গিন মনে হয়। ভালোবাসা পাওয়ার সঙ্গী খুঁজতে থাকে চোখের সীমানা জুড়ে। মনের ইচ্ছা গুলো ভাবনার সাথে মিশে যায় একই সুরে। ব্যতিক্রম ছিল না তেরো বছরে পা দেয়া ক্লাশ এইটে পড়ুয়া ‘নয়ন’ও।

গ্রামের ছেলে নয়ন, বাবা-মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। পার্শ্ববর্তী গ্রামের একটি হাই স্কুলে অষ্টম ক্লাশের ছাত্র নয়ন। লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালই, গত ফাইনাল পরিক্ষায় ক্লাশ সেভেন থেকে এইটে উঠেছে তৃতীয় হয়ে। হাস্যকর চঞ্চলা প্রকৃতির নয়ন ক্লাশ তথা পুরো স্কুলের সকল ছাত্রছাত্রী এমনকি শিক্ষকদের নিকট মোটামুটি জনপ্রিয়। সবাই তাকে আদর করে। সারাক্ষণ মুখে গুনগুন সুরে গান লেগেই থাকতো তার। গান তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। গাইতোও বেশ, যেমন মিষ্টি কণ্ঠ তেমনি যেকোনো শিল্পির সুরই সুন্দর মিলে যেতো তার সাথে। স্কুলের প্রতি বৃহস্পতিবার চার পিরিয়ড শেষে গানের প্রতিযোগিতা চলতো রেগুলার। সেই প্রতিযোগিতায় কখনো প্রথম কোনদিন দ্বিতীয় হতো। তার আগের ক্লাশেরই আরেটা ছেলে মন্তাজ খুব সুন্দর গাইতো। মাঝে মাঝে মন্তাজ প্রথম হইতো গানে। নয়নও ভালই গাইতো, তবে মাঝেমধ্যে তাল কাটা পড়ায় পিছিয়ে পড়তো নয়ন। যা হোক, এভাবেই হাসি খুশিতেই চলতে থাকলো নয়নের স্কুলের দিন গুলি।

কেন জানি বেশ কয়েকদিন যাবত নয়নের সময় ভাল যাচ্ছে না। সেদিন একটু সকাল সকাল স্কুলে এসে পড়েছে। ক্লাশে ডুকে দেখে কার যেন বই রাখা বেঞ্চের উপর কিন্তু কেউ নেই তবুও বুঝে গেল যে বইগুলো আমির সাহেবের। কারণ, তার জায়গাতেই বইগুলো রাখা। আমির আলী ক্লাশের সবচেয়ে ভাল ছাত্র। এক নম্বর রোল তার, নয়নের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। আমির আলীকে সবসময় আমির সাব বলেই ডাকতো নয়ন। স্কুল এবং স্কুল শেষে নয়ন যাদের সঙ্গে ঘুরাফরা করে আড্ডা দেয় তাদের মধ্যে একজন। দু’জনের মধ্যে এতোই গরিষ্ঠতা যে সারাদিনের চিন্তাভাবনা সবই শেয়ার করতো তার সাথে। তার বই দেখে খুশিই হলো নয়ন। যাক একজনকে তো পাওয়া গেল। কিন্তু তাকে দেখতে না পেয়ে একটু অবাকই হল। সারা স্কুল ফাঁকা কোথাও সাড়াশব্দ নাই। তো গেল কই….! নিজের বই বেঞ্চে রেখে বেরিয়ে এলো ক্লাশ থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছে কই গেল আমির সাব। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

মনে মনে ভাবছে অনেক কিছু, তবে বারবার কেবল ঘুরেফিরে একজনকেই মনে পড়ছে। আজকাল তাকে খুব বেশি বেশি মিস করতে শুরু করেছে নয়ন। তাকে দেখলেই কেমন যেন আনমনে হয়ে যায় সে। মনের আকাশে রঙিন ঘুড়ি উঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কিছু বলার সাহস করতে পারে না। যদিও একই ক্লাশের মেয়েটি, তবুও সব কথা বললেও আসল কথাটি বলতে পারছে না। কি যেন ভয়, কি জানি কি হয়…..। আজ সকাল সকাল স্কুলে আসার সাথেও সেই কারনটাই প্রধান। যদি সেও একটু আগে আসে তো কিছু বলতে না পারলেও দেখতে তো পারবে। তাকে দেখতে যে দারুণ লাগে। যেমন সুন্দর চেহারা তেমনি শরীরের গড়ন তার। মুগ্ধ নয়ন তার চেহারা দেখেই।

না, এখনো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কমন রোমের দিকে নজর গেল হঠাৎ দরজার শব্দ শোনে। স্কুলের উত্তর দিক দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে মিরা আসছে। মিরা প্রায়ই এই সময়ই আসে। একই ক্লাশে তারা। মিরা কেন জানি ইদানিং নয়নের সাথে কথা বলতে আগ্রহী বেশিই মনে হয়। মিরা মেয়েটি সহজ সরল নাজুক প্রকৃতির খুব সুন্দর দেখতে। এর মধ্যে স্কুলের আরও ছাত্রছাত্রী আসতে শুরু করেছে।
কমনরুম থেকে আমির সাবকে বের হতে দেখে কিছু বুঝে উঠার আগেই মিরা কাছাকাছি এসে বললো-
কেমন আছো নয়ন। কখন আসলে?
এইতো কিছুক্ষণ। তুমি ভাল আছো? পাল্টা প্রশ্ন করে আমির সাহেবের দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে নয়ন। মিরা ভাল আছি বলে পাশদিয়ে কমনরুমের দিকে চলে গেল।
কি ব্যাপার নয়ন সাব কখন এলেন? বলে ক্লাশরুমে ডুকলো আমির। এইতো কিছুক্ষণ জবাব দিয়ে ক্লাশরুমে ডুকে নয়ন বলছে-
কি ব্যাপার আমির সাব ব্যাপার কি আপনার? এত সকাল বেলা আপনাকে তো পাওয়া যায় না। আজ কেন?
না এমনিতেই। বলে আমির আলী বসল বেঞ্চে।
এমনিতে মানে? কমন রুমে কি করছিলেন? একটু উচু স্বরে বলায় আমির বললো-
আস্তে কন, আপনারে বলবো সবই। এখন বলেন আপনি কেন আজ সকালেই আসছেন?
আমিও এমনিতেই, ভাল লাগছিল না। তাই ভাবলাম স্কুলে চলে যাই। বলতে বলতে নয়ন দরজা দিয়ে বাহিরের দিকে চেয়ে হাসছে দেখে আমির আলী বলছে-
কি ব্যাপার বলেন তো, আপনাকে বেশ কয়েকদিন যাবত মিনতির দিকে নজর একটু বেশি বেশি দিতে দেখছি মনে হচ্ছে?
হঠাৎ আমিরের মুখে মিনতি নামটা শুনে নয়ন অবাক হলেও কিছু বুঝতে না দিয়ে
না, এমনিতেই। মিনতিকে দেখিয়ে- দেখেন কি সুন্দর দেখা যাচ্ছে।
হুম, বুঝতে পারছি। লাগবো নাকি? যদি প্রেম করেন তো চেষ্টা করে দেখতে পারি। ভালই হবে, খারপ না। দেখতে শুনতে নায়িকার মতোই। আপনার সাথে মানাবে দারুণ।
আমিরের কথা গুলো শুনে ভালই লাগলো নয়নের। সে তো তেমনটাই চাইছে মনে মনে। তবুও কিছু বুঝতে না দিয়ে বললো –
চাইলেই কি সবকিছু পাওয়া যায়?
আপনি শুধু বলেন, লাগবো নাকি। আমিরের কথায় কেমন যেন জোড় লক্ষ্য করলো নয়ন। ভাবছে এত জোড় কোথায় পাইল আমির আলী। তাকে তো মিনতির সাথে বেশি মিশতেও দেখিনা।
দেখি, আর কিছু দিন যাক বলবো আপনাকে। এই বলে বাহির হয়ে বারান্দার জানালা দিয়ে বলল আমির সাব আমি দোকানে গেলাম। আপনি চাইলে আসতে পারেন। আমির বললো না, আপনিই যান। নয়ন দোকানের দিকে যাচ্ছে। বারান্দায় দেখা হলো ইয়াসমিন আর রেখা আসতেছে। কিছু না বলে মুচকি হেসে পাশকাটিয়ে যাচ্ছে নয়ন। রেখা বলে উঠল কই যাও, সিগারেট টানতে? রেখার কথায় লজ্জা পড়ে গেল নয়ন। আরে না এমনি তেই। হুম বলে তারা চলে গেল। নয়ন দোকানে ডুকে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছে। তখনো নয়ন পুরোপুরি সিগারেট খায় না। মাঝে মাঝেমধ্যে টানে স্কুলে এলেই। তবে আজ যেন পাকা সিগারেট খোরের মতো টানছে। দোকানে আগে থেকেই বসা ছিল হানিফ। নয়নের সিগারেট টানার স্টাইল দেখে হানিফ বললো –
কিরে, তুই দেখা যায় সিগারেট পুরোপুরিই ধরলি। তোর পুরা নেশা হয়ে গেছে। আর ছাড়তে পারবি না দেখিস।
আরে না, সিগারেট আমার নেশা হবে না কখনো, দেখিশ। নয়ন দৃঢ়ভাবেই বলল।
দেখা যাবো।

দেখিস- বলে সিগারেটে ঘনঘন টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে একটু পানি মুখে নিয়ে গড়গড় করতে করতে আবার স্কুলের দিকে যাচ্ছে নয়ন। বারান্দয় ডুকে কমনরুমের দিকে চেয়ে দেখলো মিনতি, খালেদা মিরা আর ইয়সমিন কমনরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। নয়নের দিকে চেয়ে কি যেন বলছে আর হাসছে তারা। নয়ন এসে ক্লাশের ভিতরে বসে পড়লো। ক্লাশে আরও অনেকেই বসে আছে। প্রায় সবাই এসে পড়েছে। সবাই বই দেখছে। আলীকে জিজ্ঞাস করল কিরে আলী এখন কোন ক্লাশ? প্রথম ক্লাশ তো ইংরেজী হওয়ার কথা ছিল, ইব্ররাহীম স্যার আসেনি এখনো, দেখি কোন স্যার আসে- বললো আকরাম। আকরাম ক্লাশের সেকেন্ড বয়। লেখাপড়ায় খুবই মনোযোগী। ভাল ছাত্র। তার পাশের মাঝখানের সিটেই বসে নয়ন আর দরজার কাছে প্রথম বসে আমির আলী।

রশিদ স্যার এসে ক্লাশে ডুকলো। রশিদ স্যার বাংলা ক্লাশ নেয়। স্যারের পিছনে পিছনে মেয়েরা ডুকছে। মেয়েরা স্যারের সঙ্গেই ক্লাশে আসে আবার চলেও যায় স্যারের সঙ্গে। সবাই দাঁড়িয়ে স্যারকে সম্মান জানায়। স্যার বসতে বললেই বসে সবাই।
প্রথম বেঞ্চে বসায় প্রায় সামনে দিয়েই যেতে হয় মেয়েদের। মিনতি যখন ডুকে তখন নয়ন মুখে ফু দিয়ে মিনতির চুল উডায়। এটা প্রতিবারই করে ডুকতে ও বের হওয়ার সময়। আজও করলো। মিনতির সামনের কিছু আগলা চুল থাকতো। যা ফু দিলে উড়তো। নয়ন এতেই খুশি। ক্লাশে বারবার মিনতির দিকে তাকাতো নয়ন। সবই বুঝতো মিনতি কিন্তু কোন সময় প্রতিবাদ করতো না সে। তাই বুঝি নয়ন এসব করার সাহস পেতো। মিনতির দিকে চেয়ে আছে নয়ন। আহ! কি সুন্দর। খালেদা কাশি দিয়ে নয়নকে চোখের ইশারায় সাবধান করলো এই প্রথম। এর আগেও নয়ন এরকম করেছে। কিন্তু আজই প্রথম সাবধান করলো কেউ। দেখতো ক্লাশের সবাই, জানতোও, কিন্তু কেউ কিছু বলতো না। এমনকি মিনতিও না। স্যার হাজিরা রোল ডাকছে।

কয়েক দিন পর…..

চার পিরিয়ড শেষ, টিফিন চলছে। প্রচণ্ড গরম সেদিন। রোদ্দুর খেলা করছে চারিদিকে। সবাই এদিক সেদিক ঘুরছে, মাঠের ওপাশটায় গাছের ছায়ায় বসে আছে। নয়ন টিউবয়েলে যাচ্ছে পানি খাবে। কমনরুমের সামন দিয়ে লাইব্রেরী থেকে গ্লাস নিয়ে টিউবয়েলের কাছে যেতেই খালেদা ডাকছে-
নয়ন দাঁড়াও, গ্লাসটা দেও ধুঁয়ে দিই।
নয়ন গ্লাসটি খালেদার হাতে দিয়ে টিউবয়েলের কাছেই দাঁড়িয়ে দেখছে, খালেদা গ্লাসে পানি নিয়ে হাত দিয়েই ধুইছে।
নয়ন তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। লাইব্রেরীর কাছেই টিউবয়েল থাকায় স্যারদের শুনে ফেলার ভয়ে আস্তে আস্তেই বললো খালেদা।
আচ্ছা বল।
নয়ন বুঝতে পারছেনা কি বলতে চায় খালেদা। আগ্রহ নিয়ে শোনার অপেক্ষায় নয়ন।
খালেদা গ্লাস পরিষ্কার করে পানি ভরে নয়নের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছে-
আমি বেশকিছু দিন যাবত লক্ষ্য করছি।
কি ?
তুমি মিনতির দিকে বেশি বেশি তাকাও, ফু দাও আসতে যাইতে।
তয় কি বিচার করবা নাকি? হাসতে হাসতে বলে খালেদার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খাচ্ছে নয়ন।
না, বিচার না। মিনতিও তোমার কাজকারবার বুঝে। তুমি কি মিনতির সাথে প্রেম করবা?
নয়ন অবাক হয়ে শুনছে, আনন্দে আত্মহারা। এমন একটা কথা খালেদার মুখে শুনবে আশা না করলেও মনে মনে এমন কথা শোনার অপেক্ষা করছে অনেক দিন যাবত। কিছু বলতে পারছে না।
কি, কিছু একটা কও?
তোমারে কে বলছে এইসব?
মিনতিই বলছে, তুমি রাজি থাকলে তোমার সাথে প্রেম করতে চায় মিনতি।
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি ওকে বলতে বলবা।
না, সে বলতে পারবে না। তুমি একটা চিঠি নিয়ে আসবা।
না, ওকেই আগে দিতে বল। আমি জানি না, কি লিখবো।
আচ্ছা, আগামীকাল সকাল সকাল স্কুলে আসবা। এই বলে খালেদা চলে গেল।

চলবে....

তোমার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনি


ওই আকাশের চাঁদটি দেখো, কতো হাস্য-উজ্জল, মুগ্ধ পৃথিবী তার জ্যোৎস্নাময়ী রূপ দেখে। তুমি তেমনি আলোকিত হয়ে থাকো আমার মনের আকাশ জুড়ে। আমি দেখিব মুগ্ধ নয়নে, ভাসিব আলোর মিছিলে তোমার জোছনায়-মুগ্ধতা বুকে নিয়ে। আমি গেয়ে যাবো গান ওমুখ দেখে দেখে-স্বপ্নমুখর হয়ে ভাসিব কল্পনায় রাত্রি হয়ে। নেচে উঠবে মন-তোমার হাসির ছন্দ-তালে, নাচবে হিয়া সেই হাসির সুরে সুরে। 


নীল হয়ে থেকো আমার জীবন আকাশে, আমি দূর হতে ও-নীল মাখি হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে। ঘুরিব তোমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশিয়া-আমি কল্পনায় ভাসিব স্বপ্ন-যানে। তুমি শুধু বুলিয়ে দিও আলতু করে, আমি মুহূর্তেই চঞ্চল হয়ে উঠিব তোমার ভালোবাসার পরশে। শুষ্ক মেঘের ডানায় চড়ে, ছোটে যাবো খুব কাছাকাছি, মন ভরে হৃদয় চক্ষু দিয়া দেখবো- একান্ত আপন হয়ে মিশে রবো তোমাতে। বলবো, বড় বেশি ভালোবাসি তোমায়- তাই চলে এসেছি প্রিয়া-থাকতে পারিনি দূরে। তুমি শুধু মুখ ফিরিয়ে নিও না, দিও ঠাই তোমার হৃদয় কোণে। 


তুমি সাগর হলে প্রিয়া, আমি পড়ে রবো হয়ে সাগরের পাড়। তোমার বুকে জেগে উঠা ভালোবাসার ঢেউ গুলো-ক্ষণেক্ষণে আমার বুকে এসে আঁছড়ে পরবে- পরম তৃপ্তিতে ভরে যাবে বুক আমার। তোমার লোনা জলে মিশে যাবো, ভাসবো, খেলবো, মন চাইলে দেবো ডুব সাঁতার। ভরে উঠবে মন, দেখে তোমার ঢেউ গুলোর গর্জন-তাল, নাচন। নাচতে নাচতে এসে ছোঁয়ে যাবে আমার হৃদয়ের ভেতর-বার। আমি জেগে রবো দিনরাত প্রতিক্ষণ- যদি কখনো তন্দ্রাবেশ হয়-বুজে আসে চোখ, তোমার গর্জনধ্বনি আর ঢেউ এসে ঘুম ভাঙাবে আমার। জনশূন্য নীরব পাড়ে শুধু তুমি আর আমি, মিশে রবো গোপনে- হবো চিরযৌবনা এক আত্মার।


অনুক্ষণে সরোবর নীরব কথন, ভুলিতে নাহি পারি হয়'গো স্মরণ!
প্রেম-তত্ত্বে হয়ে মত্ত কতশত ক্ষণ, ভেসেছি স্বপ্নলোকে ঘুরছি মধুবন।। 


তুমি হিমালয় হয়ে থেকো সু-উচ্চ, আমি তোমার উঁচু-বুকে দাঁড়িয়ে দেখবো নতুন সূর্য। ঘুচে যাবে অন্ধকার, স্নিগ্ধ সকাল, তোমার বুকে জন্মানো দুব্বা-ঘাসে লেগে থাকা শিশিরজল, আমার কম্পন ঠোটে লাগিয়ে-বুঝে নেবো তোমার ভালোবাসার মিষ্টতা, ভরে যাবে হৃদয়, হবো উচ্ছসিত। তোমার সাথে আকাশের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে, মেঘ ছোঁব দু'হাতে। পাশাপাশি তুমি আর আমি এক সাথে দেখবো নীলাদ্রী। ভাবতেই আমি হই আনন্দে উদ্বেলিত। আহ! কি অসাধারণ মনে হবে সে মুহূর্ত! তোমার বুকের ভালোবাসা ছোঁয়ে নেমে আসা-ঝর্ণা ধারায় ভিজাবো আমার অশান্ত মন, তপ্ত হৃদয় ভিজে হয়ে যাবে শান্ত। তুমি শুধু তোমার বাহুডোরে আগলে রেখো, আমি তাতেই হবো পূর্ণ।


প্রিয় মুখটিকে মলিন- কে দেখিতে চায়!
ও-মুখে হাসি ভরে থাকুক- এই'তো কামনায়।
বিরহ যেন বাঁধে না বাসা- ও-মনে কভু হায়!
তবে যে সুখের ভুবন আমার- ভরবে বেদনায়।।


প্রকৃতির সামান্য অবহেলায় বৃক্ষ দেখো- তার ডালপালা থেকে সব পাতা শুকিয়ে শুকিয়ে পড়ে যেতে থাকে। এক সময় মানুষের কঙ্কালের মতোই মনে যেন বৃক্ষটাকে। কোনো পাতা নেই, সবুজতা হারিয়ে কেমন যেনো দোষর বাদামী বর্ণের হয়ে গেছে গাছের কাণ্ড গুলো। পাতাহীন ডালপালা নিয়ে বৃক্ষটির বেঁচে থাকার যন্ত্রণাটুকু কখনো কি অনুভব করেছো...? মৃতের মতো জীবিত বিবর্ণ গাছটিকে কতটা কষ্ট বুকে নিয়ে প্রকৃতির সদয়ের প্রতীক্ষায় দিন গুনতে হয়, তা কি কখনওই তুমি বুঝেছো ...? 

না! তুমি বুঝনি কখনো, তোমার মনে অনুভূত হয়নি কখনওই! তোমার শূন্যতা আমাকে সেই মৃতের মতো জীবিত বিবর্ণ গাছটির মতোই করে তুলে। কোনো ভাষা নেই তোমার ভাবনায়। কোনো প্রাণ নেই, অনুভূতিরা সব যেন কেমন ভোঁতা হয়ে যায়। তখন আর কোনো আনন্দই আমাকে উদ্বেলিত করতে পারেনা। যেন! জীবন থেকে সব সুখানুভূতি হারিয়ে গিয়ে-কষ্টের মহাসাগরে ডুবে যেতে থাক...। তুমি একটি বারও আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার হাতটি বাড়াও না, আমি ডুবে যাই! আমার কষ্টগুলো তোমাকে কাঁদায় না। তোমার অনুভূতিতে আমার কামনা গুলো অনুভূত হয় না কখনওই! অথচ! সেই মৃতের মতো বিবর্ণ বৃক্ষটির প্রার্থনা প্রকৃতি ঠিকই শোনে, বোঝে-আবার ভরিয়ে দেয় তার ডালপালা সবুজ পাতায়। বৃক্ষটি তার হারানো সৌন্দর্য ফিরে পায়। আনন্দে বাতাসে দোলায় বৃক্ষ পাতা-যেন প্রকৃতিকে হাত নেড়ে জানায় কৃতজ্ঞতা।

বৃক্ষের প্রতীক্ষার অবসান হলেও... আমার প্রতীক্ষা-কষ্টের প্রহর গুলো শেষ হয় না। তুমি আসো না ফিরে এই মৃত হৃদয়ে প্রাণ হয়ে। আমার কষ্টের সাগরে আসে না ভেলা হয়ে তোমার ভালোবাসা...। আসলে! তুমি আমাকে ভালোবাসো না। যা দেখাও সবই তোমার ছলনা। তুমি ছলনাময়ী-তুমি প্রতারণা করে সুখ খুঁজে পাও। আমি প্রতারিত হয়েও ভালোবেসে যাই, তোমার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনি।


যদি তোমার হৃদয় কখনো নরম হয়, যদি কোন মায়ায় ফিরে এসে বলো-আমি এসেছি প্রিয়... এই হাতটি ধরে রেখো। আমি মুহূর্তেই জীবনের কষ্ট-যন্ত্রণা সবকিছু ভুলে তোমার হাতটি ধরে নেবো... ছাড়বো না-মরণের আগে। রাখবো হৃদয় রাজ্যের রানী করে। দেখবো ও মুখ আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে-সকাল সন্ধ্যা সাজে। হবো পৃথিবীর মহা-সুখী, বলবো, 'ভালোবাসা' আমি পেয়েছি... যাকে ভালোবাসি।। 

শুক্রবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৭

আট বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়;

বৃহস্পতিবার (১২/১/২০১৭ইং) জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসির ভাষণ;

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত-সমৃদ্ধ, সুন্দর এবং বাসযোগ্য বাংলাদেশ উপহার দিতে দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আট বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ। সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের সর্বজনীন মডেল।

প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা চলতি মেয়াদের তিন বছর অতিক্রম করলাম। আমাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা আশা করি সকল রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে গঠিত নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখবেন। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নিবেন এবং দেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে সহায়তা করবেন।

টানা দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের তিন বছরপূর্তি দিবসে বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার টানা ৮ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে ৯ম বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছি। আপনাদের (দেশবাসী) প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছি- সে বিচারের ভার আপনাদেরই ওপরই রইল। তবে আমি এটুকু দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, দেশের এবং দেশের মানুষের উন্নয়ন এবং কল্যাণের জন্য আমরা আমাদের চেষ্টার ত্রুটি করিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের তৃতীয় বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনও জানান।

তিনি বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, বিপুল জনসংখ্যার এদেশের সম্পদের পরিমাণ সীমিত। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিপুল জনসংখ্যার এদেশে সম্পদের পরিমাণ সীমিত। দীর্ঘকাল দেশে কোন আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়নি। বহু সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়ে পাহাড়-সমান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মোকাবেলা করতে হয়েছে অভ্যন্তরীণ বিরুদ্ধ পরিবেশ। বৈশ্বিক বৈরী অর্থনৈতিক অবস্থাও উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বার বার। কিন্তু সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি আজ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকারও বেশি। যা জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বে ৪৪তম এবং ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩২তম। আর ধারাবাহিকভাবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রবৃৃদ্ধি ধরে রেখে পুরো বিশ্বকে আমরা তাক লাগিয়ে দিয়েছি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ১১ ভাগ। আগামী বছরের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ ভাগ।

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে প্রায় ৩৪ মিনিটের জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের উন্নয়ন-সফলতা তুলে ধরার পাশাপাশি বাকি দুই মেয়াদের পরিকল্পনা, বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াল নাশকতা, নানামুখী ষড়যন্ত্র এবং জঙ্গী নির্মূলে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথাও দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একযোগে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচার করে।

একটি গোষ্ঠীর দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা ॥ প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন একটি গোষ্ঠী ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করার অপচেষ্টা করছে। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্মের নামে যারা মানুষ হত্যা করে তারা ইসলামের বন্ধু নয়, শত্রু। ইসলাম কখনও মানুষ হত্যা সমর্থন করে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ তবে ধর্মান্ধ নয়। হাজার বছর ধরে এ দেশের মাটিতে সকল ধর্মের মানুষ সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তিতে বসবাস করে আসছেন। যারা এই ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়, তাদের ঠাঁই বাংলার মাটিতে হবে না।

শেখ হাসিনা দেশের সকল ইমাম, মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, স্থানীয় মুরুব্বি, আনসার-ভিডিপি সদস্য এবং অভিভাবককে জঙ্গী তৎপরতার বিরুদ্ধে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, অভিভাবকদের প্রতি বিশেষ করে আমার আহ্বান, আপনাদের সন্তানের প্রতি নজর রাখুন। তাদের এমনভাবে পরিচালিত করুন, যাতে তারা ভুল পথে পা না বাড়ায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ অব্যাহত আছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আমরা অবৈধ পথে ক্ষমতা দখলের পথ রুদ্ধ করেছি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমরা জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনকালীন একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কারণ আমরা সব সময়ই সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। সংবিধানের আওতায় আমরা সব ধরনের ছাড় দিতেও প্রস্তুত ছিলাম। এমনকি বিএনপি যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক, তাও আমরা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি বরং উনি সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেন।

বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াবহ নাশকতার কথা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনে না এসে বিএনপি-জামায়াত জোট পেট্রোলবোমা, অগ্নিসংযোগ ও বোমা হামলা করে মানুষ হত্যায় মেতে উঠলেন। শতাধিক মানুষ হত্যা করলেন। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করলেন। তিনি বলেন, বিএনপি জোট নির্বাচন বর্জন করলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দল এবং প্রার্থীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠুভাবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের সময় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত ছিল। সরকার কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি।

তিনি বলেন, টানা ৯২ দিন পার্টি কার্যালয়ে আরাম-আয়েশে অবস্থান করে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আন্দোলনের নামে বিএনপি নেত্রী (খালেদা জিয়া) আবার জ্বালাও পোড়াও-সন্ত্রাসী কর্মকা- উসকে দেন। এ তিন মাসে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের হাতে ২৩১ জন নিরীহ মানুষ নিহত এবং ১ হাজার ১৮০ জন আহত হন। তারা ২ হাজার ৯০৩টি গাড়ি, ১৮টি রেলগাড়ি ও ৮টি লঞ্চে আগুন দেয়। ৭০টি সরকারী অফিস ও স্থাপনা ভাংচুর এবং ৬টি ভূমি অফিস পুড়িয়ে দেয়। দেশবাসী তাদের এ সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রত্যাখ্যান করেছেন। জনগণ এ ধরনের কর্মকা-ের পুনরাবৃত্তি দেখতে চান না।

আওয়ামী লীগ কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী ॥ দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা থেকে শুরু করে এ দেশের যত উল্লেখযোগ্য অর্জন, তার সবই এনেছে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। জাতির পিতা আমাদের মাথা নত না করতে শিখিয়েছেন। আমরা সকল বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করব।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ব, ইনশাআল্লাহ। তাই দেশবাসীর প্রতি আমার আহ্বান, আসুন, দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত করি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত-সমৃদ্ধ, সুন্দর এবং বাসযোগ্য বাংলাদেশ উপহার দেই।

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে ॥ প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি আজ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকারও বেশি। যা জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বে ৪৪তম এবং ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩২তম। ধারাবাহিকভাবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রবৃৃদ্ধি ধরে রেখে পুরো বিশ্বকে আমরা তাক লাগিয়ে দিয়েছি। অর্থনীতি ও সামাজিক সূচকের অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার এবং নি¤œ-আয়ের দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছি।

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি প্রকাশিত প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সের রিপোর্ট তুলে ধরে বলেন, রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৯তম ও ২০৫০ সাল নাগাদ ২৩তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হবে। জনগণের মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ সালের ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে আজ ১ হাজার ৪৬৬ ডলার হয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২০০৫-০৬ সালে ছিল সাড়ে ৪১ শতাংশ। এখন তা হ্রাস পেয়ে হয়েছে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ। অতি দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ২৩ থেকে ১২ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৫-১৬ শতাংশে এবং অতি দারিদ্র্যের হার ৭-৮ শতাংশে নামিয়ে আনা।

তিনি বলেন, একদিকে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যেমন বেড়েছে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে থাকায় মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে। ২০০৯ সালে মূল্যস্ফীতি ছিল ডাবল ডিজিটে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল মাত্র ১০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৪ দশমিক ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমরা জাতীয় রফতানি নীতি ঘোষণা করেছি এবং বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ শক্তভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বর্তমানে ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও ওপর । বিগত আট বছরে দেশ-বিদেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। গত বছর রেকর্ড ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। ৫ কোটি মানুষ নি¤œবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে।

বিদ্যুত প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে আমরা যখন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেই, তখন বিদ্যুত উৎপাদন ছিল ৩ হাজার ২শ’ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুত উৎপাদন প্রায় ১৫ হাজার ৩শ’ মেগাওয়াট। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত সুবিধার আওতায় এসেছে। তিনি বলেন,

২০২১ সালের মধ্যে আমরা ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দিতে চাই। সেই লক্ষ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে হবে। কয়েকটি বৃহৎ বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু করেছি।

আমি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে আমরা পরিবেশ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।

যোগাযোগ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন ॥ তাঁর সরকারের গত ৮ বছর মেয়াদে দেশের যোগাযোগ খাতের ব্যাপক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের যোগাযোগ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ৪৮টি বৃহৎ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকায় হাতিরঝিল প্রকল্প, কুড়িল-বিশ্বরোড বহুমুখী উড়াল সেতু, মিরপুর-বিমানবন্দর জিল্লুর রহমান উড়াল সেতু, বনানী ওভারপাস, মেয়র হানিফ উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। মেট্রোরেল নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন চালু হয়েছে। নবীনগর-ডিইপিজেড-চন্দ্রা সড়ক এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। চন্দ্রা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত দেশের প্রথম আট লেনের মহাসড়ক চালু করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় কাঁচপুর, ২য় মেঘনা এবং ২য় গোমতি সেতু নির্মাণের কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। আওয়ামী লীগ সরকার রেলওয়েকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে দ্রুতগতিসম্পন্ন এক্সপ্রেস ট্রেন চালু করা হয়েছে। ইলেকট্রিক ট্রেন ও পাতাল ট্রেনের সম্ভব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। তিনি বলেন, সরকার নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে যাত্রী পরিবহনের জন্য ৪৫ নৌযান নির্মাণ ও চালু করেছে। দুইটি যাত্রীবাহী জাহাজ ও চারটি সি-ট্রাক জাতীয় নৌপরিবহনে সংযুক্ত হয়েছে। নৌ-পথের নাব্য বৃদ্ধি করতে ১৪টি ড্রেজার কেনা হয়েছে। আরও ১৭টি ড্রেজার ক্রয় প্রক্রিয়াধীন আছে।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এক সময়ের মৃতপ্রায় মংলাবন্দর আমাদের সরকারের সময়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীতে পায়রা সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম শুরু হওয়ার ফলে ওই অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকা- বৃদ্ধি পাচ্ছে। পায়রা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা বাংলাদেশ বিমানের জন্য ৬টি সুপরিসর উড়োজাহাজ সংগ্রহ করেছি। ২০১৮ সাল নাগাদ আরও ৪টি উড়োজাহাজ সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলছে। পদ্মা সেতুর অপর প্রান্তে মাদারীপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণের সমীক্ষার কাজও শীঘ্রই শুরু হবে।

আমরা শান্তি এবং সহাবস্থানে বিশ্বাসী ॥ কূটনৈতিক সফলতার বিবরণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শান্তি এবং সহাবস্থানে বিশ্বাসী। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল বৈশিষ্ট্য ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়।’ এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন পথ রচনায় সক্ষম হয়েছি। তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমে আমরা ভারতের সঙ্গে স্থলসীমানা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করেছি। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমারও শান্তিপূর্ণ সমাধান করেছি। এর ফলে বিশাল সমুদ্র এলাকায় সমুদ্রসম্পদ আহরণের পথ সুগম হয়েছে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখবে। কক্সবাজারে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলেছি। সেখানে সী এ্যাকুরিয়াম তৈরি করা হবে। আর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমরা এমডিজি অর্জন করেছি। বাংলাদেশ এমডিজি এ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ এ্যাওয়ার্ড এবং আইটিইউ-এর ‘ওয়াল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি’ পুরস্কার পেয়েছে। আমরা জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমাদের ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এসডিজি’র ৫৬টি লক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ॥ তাঁর সরকারের মেয়াদে নারীর ক্ষমতায়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় দেশগুলোর অন্যতম। আর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদে নারীর অবস্থানের দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদকে সকল কর্মকা-ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছি। তিনি এ জন্য বিরোধীদলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তারা বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অভিমত দিচ্ছেন, আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন।

সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ১২৩ ভাগ বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সামরিক-অসামরিক সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ১২৩ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। পদমর্যাদা বৃদ্ধি ও ব্যাপক পদোন্নতির সুযোগ করে দিয়েছি। সশস্ত্র বাহিনীকে অত্যাধুনিক যুদ্ধসরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ও সশস্ত্রবাহিনীর ঝুঁকিভাতা দেয়া হচ্ছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩শ’ টাকা করা হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৮ বছরে আমাদের নিরলস প্রচেষ্টায় ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। ৫ হাজার ২৭৫টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার এবং ৮ হাজার ২শ’ ই-পোস্ট অফিস থেকে জনগণ দুই শ’ ধরনের ডিজিটাল সেবা পাচ্ছেন। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত অপটিক্যাল ফাইবার সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন ১৩ কোটির বেশি মোবাইল সিম ব্যবহার করা হচ্ছে। ইন্টারনেট গ্রাহক প্রায় ৬ কোটি। চলতি বছরের মধ্যেই মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের লক্ষ্যে কাজ চলছে। এছাড়া ২৫ হাজার ওয়েবসাইট নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব পোর্টাল ‘তথ্য বাতায়ন’ চালু করেছি, যা আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত হয়েছে।

বৈদেশিক বিনিয়োগ ২২৩ কোটি ডলার ॥ দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্পের বিকাশ ও বিস্তৃতির জন্য সবচেয়ে উদার নীতি গ্রহণ করেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে ২২৩ কোটি ডলার। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছরে ২০০৬ সালে যা ছিল মাত্র ৪৫ দশমিক ৬ কোটি মার্কিন ডলার। তিনি বলেন, শিল্পায়ন এবং বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে। এতে এক কোটির বেশি লোকের কর্মসংস্থান হবে।

তিনি বলেন, আমাদের সরকার মুক্তবৃদ্ধি ও মুক্তচিন্তার স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। আমরা দেশে সর্বপ্রথম জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাসহ তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। বেসরকারী খাতে ৪৪টি টেলিভিশন, ২২টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে সরকার থেকে পাঁচ কোটি টাকার সিডমানি, এক কোটি ৫৮ লাখ টাকার অনুদান এবং ৭ কোটি ১০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছি। সাংবাদিকদের সহায়তায় এ পর্যন্ত ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

ঘাটতি মিটিয়ে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ বাংলাদেশ ॥ কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা। গত আট বছরে দেশে কৃষি খাতের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদন প্রায় ৪ কোটি মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ এখন খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়েছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ এবং সবজি উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে। তিনি বলেন, ৮ বছরে প্রায় ৪০ হাজার ৩শ’ কোটি টাকার কৃষি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বর্গা চাষীদের জন্য কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে বিনা জামানতে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করেছি। ১৯৯৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার বয়স্কভাতা, বিধবা ও দুস্থনারী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধাভাতা এবং প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বিভিন্ন সামজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচী চালু করেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অধীনে চলতি বছর ১৪২টি কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী ॥ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করেছি। কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করার ব্যবস্থা নিয়েছে। কয়েক ধাপে উপজেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে নির্বাচন হয়েছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরেই সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচন হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

প্রতি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় ॥ শিক্ষা খাতের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০১০ সালে আমরা মাধ্যমিক পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ কর্মসূচী শুরু করি। এ বছর ৪ কোটি ২৬ লাখ ৫৩ হাজার ৯২৯ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। গত আট বছরে সর্বমোট প্রায় ২২৫ কোটি ৪৩ লাখ ১ হাজার ১২৮টি বই বিতরণ করা হয়েছে। বিশ্বে বিনামূল্যে বই বিতরণের এমন নজির নেই।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছি। একইসঙ্গে এসব বিদ্যালয়ের ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষকের চাকরি সরকারী করা হয়। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩১ হাজার ১৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যালয়বিহীন ১ হাজার ১২৫টি গ্রামে নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। যেসব উপজেলায় সরকারী স্কুল বা কলেজ নেই, সেসব উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারীকরণ করা হবে।

তিনি বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় গিয়ে শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ থেকে ৪৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৯টি এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৬টি। চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে দুটি নতুন মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আইন পাস করা হয়েছে। আর যেসব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নেই, সেসব জেলায় একটি করে সরকারী বা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।

সংগ্রহ :- somewhereinblog.net লিখেছেন- তালপাতারসিপাই