সোমবার, ৩০ জুলাই, ২০১৮

মুজিবনগর সরকার ও বঙ্গবন্ধু সরকারের সাফল্য

বাংলােদের প্রথম সরকার- মুজিবনগর সরকার

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে পাক-হানাদার বাহিনীর মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনগণকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দেন।

তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ।

মন্ত্রিসভায় আরও ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ। সরকার শপথ গ্রহণ করেন ১৭ এপ্রিল।

আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য (এমএনএ) কর্নেল (পরে জেনারেল) এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়।

প্রবাসী সরকার লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধার সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ১১টি রণাঙ্গনে ভাগ করে সাফল্যের সাথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। সেই সাথে দলীয় সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে যুবকদের সংগঠিত করে ও জনগণের মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে সহায়তা করে। মুক্ত অঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনাও ছিল মুজিবনগর সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব।

মুজিবনগর আওয়ামী লীগ সরকার বেসামরিক সচিবালয় স্থাপন করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করে দেশের ভেতরে ও বাইরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত গঠনের জন্য বহির্বিশ্বে ব্যাপক প্রচারণারও সফল আয়োজন করা হয়।

চলচ্চিত্র নির্মাণ, পুস্তিকা প্রকাশ এবং পোস্টার ও হ্যান্ডবিল-লিফলেট বিলি, সংবাদপত্র প্রকাশ ইত্যাদি কর্মকা- জোরেশোরে পরিচালিত হয়। জাতিসংঘে ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি প্রেরিত হয়। যেসব কূটনীতিক বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ও আস্থা প্রকাশ করেন তাদেরও কর্মপরিধি পরিচালিত হয় মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে। শরণার্থীদের ত্রাণ তৎপরতায়ও মুজিবনগর সরকার অত্যন্ত তৎপরতার পরিচয় দেয়।

       বঙ্গবন্ধু সরকারের সাফল্য

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত করেছিলেন, দুটি ভাগেÑ প্রথমত; পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন এবং দ্বিতীয়ত; উন্নয়ন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখতেন সুখী, সমৃদ্ধ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্য ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়-অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু শুরু করেন দ্বিতীয় বিপ্লব ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’র সংগ্রাম।

৩ কোটি ছিন্নমূল মানুষ, দেড় কোটি অগ্নিদগ্ধ ঘরবাড়ি, ১ কোটি শরণার্থীর প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন সমস্যা, শূন্য খাদ্য গুদাম, অনাবাদি জমি, অচল বন্দর, ডুবন্ত নৌযান, যোগাযোগ পরিবহন এবং অভ্যন্তরীণ নৌ ও সমুদ্র বন্দরের অচলাবস্থা, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধজনিত কারণে তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, স্বাধীনতা-বিরোধীদের অন্তর্ঘাত ও নাশকতামূলক তৎপরতায় বিপর্যস্ত জনজীবন এমন চরম বিরূপ ও সংকটাকুল পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে জাতিসংঘের স্বীকৃতি অর্জনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার যে সফলতা দেখিয়েছে বিশ্বের ইতিহাসে তা বিরাল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

তখন বিভিন্ন দেশ ও সাহায্য সংস্থা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা জরিপ করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে খাদ্যাভাবে ২ কোটি লোক মৃত্যুবরণ করবে। বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ৪ কোটি ৭৫ লাখ মণ খাদ্যসামগ্রী বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে বিতরণ করে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু ঠেকাতে সমর্থ হয়েছিলেন; বঙ্গবন্ধুর সময়োচিত পদক্ষেপে এই ভয়াবহ সংকট মোকাবিলা বিশ্ববাসীকে অভিভূত করেছিল।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও ভৈরব সেতুসহ ৫৬৭টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত, ৭টি নতুন ফেরি, ১ হাজার ৮৫১টি রেলওয়ে ওয়াগন ও যাত্রীবাহী বগী, ৪৬টি বাস, ৬০৫টি নৌযান ও ৩টি পুরাতন বিমান চালু করে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মাইন উদ্ধার করে অচল বন্দরসমূহ সচল করা হয়।

সম্পূর্ণরূপে দেউলিয়া ও প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিট জাতীয়করণ ও উৎপাদনক্ষম করে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন নতুন শিল্প কল-কারখানা গড়ে তোলার ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ ঘোষণা করে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। বিশ্বের ইতিহাসে যা একটি বিরল দৃষ্টান্ত।

তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠানো, পাকিস্তানে আটক প্রায় ৪ লাখ বাঙালিকে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসিত করা, ৭ লাখ পাকিস্তানিকে ফেরত পাঠানো, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ফিরিয়ে নেওয়া, মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদ পরিবারকে আর্থিক সাহায্য ও ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনের দায়িত্ব গ্রহণ, চিকিৎসার জন্য পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেশ প্রেরণ, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠন, প্রতি থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় ও হাসপাতাল নির্মাণ, ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগসহ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা নির্মাণ, সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীসহ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে জাতীয় মর্যাদায় পুনর্গঠন, সামরিক একাডেমি স্থাপন, পুলিশ, বিডিআর, আনসার ও বেসামরিক প্রশাসনের অবকাঠামো গড়ে তোলা, প্রতিবেশী দেশের সাথে সীমান্ত ও ফারাক্কার পানি চুক্তি, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ ও ১৪০টি দেশের স্বীকৃতি লাভের ন্যায় কারিসম্যাটিক সফলতা অর্জন, সবকিছু বাংলার জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অপরিসীম ত্যাগের মানসিকতার ফলে সম্ভব হয়েছিল।

মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকার রক্তাক্ত ধ্বংসস্তূপের মধ্যে শূন্য হাতে একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে সফলতা অর্জন করেছিল তা ছিল বিস্ময়কর ব্যাপার।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, ১৯৭২-৭৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল গড়ে ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে এ সময়ে আয় বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ৭ শতাংশ।

মদ, জুয়া, হাউজি, ঘোড়দৌড়সহ সব ইসলামবিরোধী কর্মকা- কার্যকরভাবে নিষিদ্ধকরণ, ইসলামী ফাউন্ডেশন গঠন ও মাদ্রাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠা, পবিত্র হজব্রত পালনে সরকারি অনুদান প্রদান, ইসলামি সম্মেলন সংস্থার সদস্যপদ লাভ ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।

শান্তির স্বপক্ষে বলিষ্ঠ ও দৃঢ় পদক্ষেপ কার্যকর করার অভিযাত্রায় বিশ্ব শান্তি পরিষদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সর্বোচ্চ খেতাব ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করে সারাদেশবাসীকে মহিমান্বিত করেছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতা-প্রগতি-মানবতাবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকচক্র রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এবং মার্শাল ল’ জারি করে।।
।।__ উত্তরণ।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন