০৯ ই মে, ২০১৭ সকাল ৭:২৯১
ডঃ এম এ আলী বলেছেন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু কবি হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেননি তাঁর প্রতিভা বিস্তৃত ছিল আরও অনেক সৃষ্টিশীল কর্মে। তিনি ছিলেন অনেক বড় মাপের গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, দার্শনিক এবং চিত্রশিল্পী। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন পল্লী উন্নয়ন ধারণার পথিকৃৎ। মন্তব্যের ঘরে এ দিকটার উপরেই একটু জোড় দিব বেশী, ইচ্ছা করছিল অালাদা একটা পোষ্ট দিব বিস্তারিত ভাবে , পরে ধারণাটা পরিবর্তন করে প্রাসঙ্গিক ক্রমে সংক্ষেপে এখানেই কিছু কথা তুলে ধরা হল ।
জমিদার রবীন্দ্রনাথের দারিদ্র্য ভাবনা নিয়েই বলতে চাই আগে । বলা যায় দারিদ্র ভাবনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাঁর কাব্য-উপন্যাস, ছোট গল্পে ও সংগীতে। তাঁর লেখাগুলো থেকে প্রাপ্ত দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্পর্কিত ভাবনাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শিত পন্থাই দারিদ্র্য দূরীকরণের সবচেয়ে মোক্ষম উপায় এখনো সর্বমহলে অনুভুত হয়ে আসছে । যৌবনের প্রারম্ভেই রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে স্বেচ্ছাব্রতী ও গ্রামের সাধারণ মানুষদেরকে নিয়ে পল্লী উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কবির অনুভূতি দিয়ে রচনা করেছেন
“ ... ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির
মূক সবে, ম্লানমুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনী; স্কন্ধে যত চাপে ভার
বহি চলে মন্দগতি যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার--
তার পরে সন্তানেরে দিয়ে যায় বংশ বংশ ধরি,
নাহি র্ভৎসে অদৃষ্টেরে, নাহি নিন্দে দেবতারে স্মরি,
মানবেরে নাহি দেয় দোষ, নাহি জানে অভিমান,
শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনোমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া। সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে,
সেপ্রাণে আঘাত দেয় গর্বান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে,
নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে--
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে
মরে সে নীরবে।”
নিজে জমিদার হয়েও জমিদার শ্রেণীকে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন পরগাছা। তিনি লিখেছেন: “আমার জন্মগত পেশা জমিদারি, কিন্তু আমার স্বভাবগত পেশা আসমানদারি। তিনি বলতেন আমি জানি জমিদার জমির জোঁক; সে প্যারাসাইট, পরাশ্রিত জীব... প্রজারা আমাদের অন্ন জোগায় আর আমলারা আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয় এর মধ্যে পৌরুষও নেই, গৌরবও নেই।”
বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ প্রজাদেরকে জমিদারির মালিকানাও দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কমিউনিটি ভিত্তিতে তিনি তার জমিদারী পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিমা দেবীকে তিনি লিখেন: “বহুকাল থেকেই আশা করেছিলুম, আমাদের জমিদারি যেন আমাদের প্রজাদেরই হয়, আমরা যেন ট্রাস্টির মতো থাকি। অল্পকিছু খোরাক-পোশাক দাবি করতে পারবো, কিন্তু সে ওদেরই অংশীদারের মতো।” জীবন সায়ান্নে এসে পতিসরে দেওয়া সংবর্ধনা সভায় তিনি আফসোস করে বলেছিলেন: “ইচ্ছা ছিল মান সম্মান সম্ভ্রম সব ছেড়ে দিয়ে তোমাদের সঙ্গে তোমাদের মতই সহজ হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেব। কী করে বাঁচতে হবে তোমাদের সঙ্গে মিলে সেই সাধনা করব। কিন্তু আমার এই বয়সে তা হবার নয়, আমার যাবার সময় হয়ে এসেছে।”
পল্লী উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজ তিনি পরিকল্পিতভাবে শুরু করেছিলেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই তিনি শিলাইদহে পল্লীসমাজ গড়ার কাজে হাত দেন। একইভাবে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে তাঁর জমিদারির অভ্যন্তরে লাহিনী গ্রামে ৪০/৫০ বিঘা জমির উপর পরিকল্পিত আদর্শ গ্রাম তৈরিতে সচেষ্ট হন। বঙ্গবন্ধু এই আদর্শ গ্রাম প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেন নি তার আকাল প্রয়ানের কারণে ।
রবীন্দ্রনাথ অনুধাবন করেছিলেন গ্রামের উন্নতির সঙ্গে কৃষির উন্নতি জড়িত। রবীন্দ্রনাথ উন্নতমানের কৃষিব্যবস্থা নিয়ে হাতে-কলমে যে এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনা করেছিলেন তার অংশ হিসেবে তিনি ১৯২২ সালে শ্রীনিকেতনে, যা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে অবস্থিত শান্তি নিকেতন থেকে মাইল দুয়েক দূরে, ‘ইন্সিটিটিউট অব রুরাল রিকনস্ট্রাকশন’ নামক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের প্রতি জমিদার-মহাজনের অত্যাচার সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। বিপন্ন চাষীদের মহাজনদের হাত থেকে রক্ষা করা, তাদের ঋণমুক্ত করা এবং কুটিরশিল্পের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে তিনি প্রথম শিলাইদহে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। এর প্রায় ১১ বছর পর ১৯০৫ সালে তিনি পতিসরে অনুরূপ কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের সহযোগিতা পেলেও নোবেল পুরস্কারের পুরো অর্থ (১ লাখ ৮ হাজার টাকা) তিনি পতিসর কৃষি ব্যাংকে জমা দেন।
আত্ম ও আত্মনির্ভরশীলতা উন্নয়নের জন্য রবীন্দ্রনাথ ‘চাষীকে আত্মশক্তিতে দৃঢ় করে তুলতে’ চেয়েছিলেন। তাই তিনি দরিদ্রদেরকে জাগিয়ে তোলার ওপর জোর দেন:
তিনি লিখেন
“... এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা; এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে--
‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে;
দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ সংগঠিত হওয়া ও সংগঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি লিখেন: বিদ্যা বলো, টাকা বলো, প্রতাপ বলো, ধর্ম বলো, মানুষের যা-কিছু দামী এবং বড়ো, তাহা মানুষ দল বাঁধিয়াই পাইয়াছে।”
তিনি আরও লিখেছেন: “যদি প্রত্যেক চাষা কেবল নিজের ছোটো জমিটুকুকে অন্য জমি হইতে সম্পূর্ণ আলাদা করিয়া না দেখিত, যদি সকলের জমি এক করিয়া সকলে একযোগে মিলিয়া চাষ করিত, তবে অনেক হাল কম লাগিত, অনেক বাজে মেহন্নত বাঁচিয়া যাইত। ফসল কাটা হইলে সেই ফসল প্রত্যেক চাষার ঘরে ঘরে গোলায় তুলিবার জন্য স্বতন্ত্র গাড়ির ব্যবস্থা ও স্বতন্ত্র মজুরি আছে; প্রত্যেক গৃহস্থের স্বতন্ত্র গোলাঘর রাখিতে হয় এবং স্বতন্ত্রভাবে বেচিবার বন্দোবস্ত করিতে হয়। যদি অনেক চাষী মিলিয়া এক গোলায় ধান তুলিতে পারিত ও এক জায়গা হইতে বেচিবার ব্যবস্থা করিত তাহা হইলে অনেক বাজে খরচ ও বাজে পরিশ্রম বাঁচিয়া যাইত। যার বড়ো মূলধন আছে তার এই সুবিধা থাকাতেই সে বেশি মুনাফা করিতে পারে, খুচরো খুচরো কাজের যে-সমস্ত অপব্যয় এবং অসুবিধা তাহা তার বাঁচিয়া যায়।”
রবীন্দ্রনাথের উন্নয়ন ধারণার মূল লক্ষ্য ছিল আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অসাম্প্রদায়িকতার ওপর জোর দিয়েছিলেন এবং হিন্দু-মুসলমান সবাইকে নিয়ে কাজ করেছিলেন। ‘গোরা’ উপন্যাসে তিনি লিখেছেন: ”আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই।
রবীন্দ্রনাথ জেনেছিলেন, শুধুমাত্র কৃষির ওপর নির্ভর করে একটি জাতি বাঁচতে পারে না, এই বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পোন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন। তাই রবীন্দ্রনাথ কৃষির পাশাপাশি শিল্পকেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এজন্য তিনি শ্রীনিকেতনে ‘শিল্পভবন’ গড়ে তুলেছিলেন। পল্লী উন্নয়ন চিন্তার অন্যতম পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্পর্কিত সৃজনশীল ধারণার শুধু উদ্ভাবকই ছিলেন না, তিনি এগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন। তাঁর লেখনী ও চর্চা থেকে আমরা যা পাই তা , সংক্ষেপে বলতে গেলে:
(১) দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য শিক্ষা ও আনুসঙ্গিক প্রণোদনা ও প্রযুক্তি উন্নয়ন কর্মকান্ড
(২) জনগণের আত্ম ও আত্মনির্ভরশীল উন্নয়নের জন্য তাদেরকে প্রণোদিত করা
(৩) দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত করা
(৪) সেক্টর বা খাতভিত্তিক কাজের পরিবর্তে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, পয়ঃনিষ্কাশন তথা সার্বিক গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা
(৫) কৃষির পাশাপাশি শিল্প-কারখানা ও কুটির শিল্প গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়া
এখনো আমাদের বর্তমান ধ্যান-ধারণা রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে বেশিদূর এগুতে পারেনি। বস্তুত, তাঁর দারিদ্র্য ভাবনা আমাদের জন্য এখনও আলোক বর্তিকা হিসেবে কাজ করে। রবিন্দ্রনাথকে নিয়ে যতবেশী আলোচনা করা যাবে তত বেশী তার অবদান জানা যাবে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন