শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৭

বড় ভুল করেছিলাম তোমায় ভালোবেসে (নয়ন-১-৩ পর্যন্ত )


আমি কোন লেখক নই। লেখালেখির অভ্যাসও নেই। হয়'তো ভাল পাঠকও নই। তবে বই পড়া গল্প পড়া একটা অভ্যাস আমার মধ্যে সবসময় লক্ষ্য করেছি। কোন অচেনা গল্প কিংবা চেনা কোন বিষয অথবা রূপকথা কোথাও নজরে পড়লে সেটা পড়তাম মনোযোগ সহকারেই। হ্যা, প্রায় ভাবতাম আমার নিজের জীবনের ঘটনা গুলো কোথাও লিখে রাখবো। এরজন্য অনেক সময় নতুন খাতা কিনতাম। কিন্তু দু'এক দিন লিখার পর আর সময় মনোযোগ কিছুই থাকতো না। তাই আর লিখা হয়নি আমার জীবন প্রবাহ। খাতা ফাঁকাই রয়ে যেতো।
তবে সামুতে রেজিস্ট্রেশন করার পর আবার সেই পুরোন ইচ্ছাটা নতুন করে কাজ করছে। কোনকিছু শুরু না করলে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নাই। তবে এবার ভাবছি লিখবো। ভাল গুছিয়ে না পারি। নিজের ব্লগে নিজের করেই রেখে দিবো না হয়।

সাধারণ পাঁচ দশজনের মতো আমিও অতি সাধারণ একজন। সঙ্গীত প্রিয় হাসি খুশি চঞ্চল প্রকতির স্বভাব থাকায় এলাকার প্রায় অনেকাংশ মানুষ বৈরাগী সম্বোধন করতো। আমি হয়তো খুশিই হতাম। আমি কিন্তু বৈরাগী শব্দের অর্থ জানতাম না। তবে বিরক্তিবোধো হতো না কখনো। আজ বুঝছি বৈরাগী জীবন কাকে বলে। হয়'তো মিল ছিল তাই হয়'তো অনেকেই বলেছে। যাক সেই বিষয় অনেক পরের বিষয়।
যার জীবন বৃত্তান্ত লিখছি তার পরিচয় আগে দেওয়া উচিৎ। 

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জেলা শেরপুর। অনেকেই গারো পাহাড় বলেও জানতো যদিও পাহাড় জেলার একপ্রান্তে। শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অস্থিত গজনী পাহাড়। যা 'গজনী অবকাশ' নামেই পরিচিত। 

শেরপুর সদর উপজেলার ২নং চরশেরপুর ইউনিয়ন চরশেরপুর গ্রামের শেষে শুরু সাতানীপাড়া গ্রামের। গ্রামে ঢুকে প্রথম যে বাড়িতেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এটিএম জিন্নাত আলী'র তিন ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় জনের নাম মো: নাঈম জাহাঙ্গীর 'নয়ন'। জন্ম ২৯ মার্চ ১৯৮২ইং সালে শেরপুর সদর উপজেলার ২নং চরশেরপুর ইউনিয়নের সাতানীপাড়া গ্রামে। গ্রামের মানুষ নয়ন নামেই জানতো, ডাকতো। হাস্যউজ্জল চঞ্চলতায় ভরা ছিল নয়নের বাল্য কিশোর সময়গুলি। হাসি তামাসা গান বাজনা নিয়েই মেতে থাকতো সবসময়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর খেলা ধূলায় কেটে যেতো দিনের পর দিন, মাস ,বছর।

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েও কোনোদিন দুঃখ কষ্ট তাদের তিন ভাইকে ছুতে পারেনি। সুখেই যাচ্ছিল কেটে নয়নের জীবন। পাশের গ্রামের হাইস্কুলে পড়তো নয়ন। লেখা পড়ায় মোটামুটি। পড়া লেখায় মনোযোগী কমই ছিল। তবে একেবারে খারাপ ছাত্র যে ছিল তা কিন্তু নয়। অষ্টম ক্লাসে যখন পড়ে তখন নয়নের বয়স মাত্র বারো বছর। শরীর স্বাস্থ্য ভালো তাই দেখতে বয়সের তুলনায় একটু বড়ই দেখা যেত।

হঠাৎ সেই স্কুলে একদিন নতুন এক সুন্দরী মেয়ে এসে ভর্তি হল। মেয়ে দেখতে শুনতে ভালোই পরীর লাহান ,কিন্তু পড়া লেখায় ছিল রূপ চেহারার পুরোপুরিভাবে বিপরীত। সেটা বুঝতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নি। ক্লাশ এইট থেকে নয়ন তৃতীয় রোল নিয়ে ক্লাস নাইনে উঠে। সেই সুন্দরীও কোনোরকম পাশ করে। দূর ! মেয়েটি মেয়েটি বলতে আর ভালো লাগছে না। এবার নামটাই বলে দেই। নাম ছাড়া কি আর চলে ! সত্যিই এই নামটি ছাড়া নয়নের একদিনও চলতে চাইতো না। ক্লাস নাইন থেকেই নয়নের লাইন শুরু মিনতি'র সাথে। সেই থেকেই নয়নের জীবনের ছন্দ পতনের শুরু ....

------------------------------------------------------#
দুনিয়ার সবাই কাউকে না কাউকে ভালোবাসে, ভালোবাসতে চায়, ভালোবেসে সাজাতে চায় নিজের ভবিষ্যৎ ঘর-সংসার। কিন্তু সবার পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠেনা সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যটি পূরণের। কেউ মাঝ পথে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। আবার কেউ বা জীবনের দীর্ঘপথ ভালোবেসে যেয়েও পথহারা হয়ে জীবনের যোগবিয়োগ কষে পায় শূন্য। সব ভালোবাসা, বিশ্বাস এক নিমিষে ভেঙ্গেচুরে চুরমার হয়ে যায়। নিঃস্ব হৃদয়ের বিষণ্ণতা আর ভালোবাসা হারানোর ব্যথায় পুড়তে হয় বহুদিন, বহুকাল হয়তো জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত। প্রিয়া বিরহের ব্যথিত মনের শেষ বাণী হয়ে বেরিয়ে আসে ‘বড় ভুল করেছিলাম তোমায় ভালোবেসে’ ।

নতুন জীবনের নতুন যৌবন প্রতিটি প্রাণীকুলকে ছন্দময় চঞ্চলা করে তুলে। নির্ভাবনা আর যৌবনারম্ভে মনের আকাশে ইচ্ছাগুলো দুরন্তপনা হয়ে উঠে। চোখের সামনে সবকিছুই তখন রঙ্গিন মনে হয়। ভালোবাসা পাওয়ার সঙ্গী খুঁজতে থাকে চোখের সীমানা জুড়ে। মনের ইচ্ছা গুলো ভাবনার সাথে মিশে যায় একই সুরে। ব্যতিক্রম ছিল না তেরো বছরে পা দেয়া ক্লাশ এইটে পড়ুয়া ‘নয়ন’ও।

গ্রামের ছেলে নয়ন, বাবা-মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। পার্শ্ববর্তী গ্রামের একটি হাই স্কুলে অষ্টম ক্লাশের ছাত্র নয়ন। লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালই, গত ফাইনাল পরিক্ষায় ক্লাশ সেভেন থেকে এইটে উঠেছে তৃতীয় হয়ে। হাস্যকর চঞ্চলা প্রকৃতির নয়ন ক্লাশ তথা পুরো স্কুলের সকল ছাত্রছাত্রী এমনকি শিক্ষকদের নিকট মোটামুটি জনপ্রিয়। সবাই তাকে আদর করে। সারাক্ষণ মুখে গুনগুন সুরে গান লেগেই থাকতো তার। গান তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। গাইতোও বেশ, যেমন মিষ্টি কণ্ঠ তেমনি যেকোনো শিল্পির সুরই সুন্দর মিলে যেতো তার সাথে। স্কুলের প্রতি বৃহস্পতিবার চার পিরিয়ড শেষে গানের প্রতিযোগিতা চলতো রেগুলার। সেই প্রতিযোগিতায় কখনো প্রথম কোনদিন দ্বিতীয় হতো। তার আগের ক্লাশেরই আরেটা ছেলে মন্তাজ খুব সুন্দর গাইতো। মাঝে মাঝে মন্তাজ প্রথম হইতো গানে। নয়নও ভালই গাইতো, তবে মাঝেমধ্যে তাল কাটা পড়ায় পিছিয়ে পড়তো নয়ন। যা হোক, এভাবেই হাসি খুশিতেই চলতে থাকলো নয়নের স্কুলের দিন গুলি।

কেন জানি বেশ কয়েকদিন যাবত নয়নের সময় ভাল যাচ্ছে না। সেদিন একটু সকাল সকাল স্কুলে এসে পড়েছে। ক্লাশে ডুকে দেখে কার যেন বই রাখা বেঞ্চের উপর কিন্তু কেউ নেই তবুও বুঝে গেল যে বইগুলো আমির সাহেবের। কারণ, তার জায়গাতেই বইগুলো রাখা। আমির আলী ক্লাশের সবচেয়ে ভাল ছাত্র। এক নম্বর রোল তার, নয়নের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। আমির আলীকে সবসময় আমির সাব বলেই ডাকতো নয়ন। স্কুল এবং স্কুল শেষে নয়ন যাদের সঙ্গে ঘুরাফরা করে আড্ডা দেয় তাদের মধ্যে একজন। দু’জনের মধ্যে এতোই গরিষ্ঠতা যে সারাদিনের চিন্তাভাবনা সবই শেয়ার করতো তার সাথে। তার বই দেখে খুশিই হলো নয়ন। যাক একজনকে তো পাওয়া গেল। কিন্তু তাকে দেখতে না পেয়ে একটু অবাকই হল। সারা স্কুল ফাঁকা কোথাও সাড়াশব্দ নাই। তো গেল কই….! নিজের বই বেঞ্চে রেখে বেরিয়ে এলো ক্লাশ থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছে কই গেল আমির সাব। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

মনে মনে ভাবছে অনেক কিছু, তবে বারবার কেবল ঘুরেফিরে একজনকেই মনে পড়ছে। আজকাল তাকে খুব বেশি বেশি মিস করতে শুরু করেছে নয়ন। তাকে দেখলেই কেমন যেন আনমনে হয়ে যায় সে। মনের আকাশে রঙিন ঘুড়ি উঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কিছু বলার সাহস করতে পারে না। যদিও একই ক্লাশের মেয়েটি, তবুও সব কথা বললেও আসল কথাটি বলতে পারছে না। কি যেন ভয়, কি জানি কি হয়…..। আজ সকাল সকাল স্কুলে আসার সাথেও সেই কারনটাই প্রধান। যদি সেও একটু আগে আসে তো কিছু বলতে না পারলেও দেখতে তো পারবে। তাকে দেখতে যে দারুণ লাগে। যেমন সুন্দর চেহারা তেমনি শরীরের গড়ন তার। মুগ্ধ নয়ন তার চেহারা দেখেই।

না, এখনো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কমন রোমের দিকে নজর গেল হঠাৎ দরজার শব্দ শোনে। স্কুলের উত্তর দিক দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে মিরা আসছে। মিরা প্রায়ই এই সময়ই আসে। একই ক্লাশে তারা। মিরা কেন জানি ইদানিং নয়নের সাথে কথা বলতে আগ্রহী বেশিই মনে হয়। মিরা মেয়েটি সহজ সরল নাজুক প্রকৃতির খুব সুন্দর দেখতে। এর মধ্যে স্কুলের আরও ছাত্রছাত্রী আসতে শুরু করেছে।
কমনরুম থেকে আমির সাবকে বের হতে দেখে কিছু বুঝে উঠার আগেই মিরা কাছাকাছি এসে বললো-
কেমন আছো নয়ন। কখন আসলে?
এইতো কিছুক্ষণ। তুমি ভাল আছো? পাল্টা প্রশ্ন করে আমির সাহেবের দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে নয়ন। মিরা ভাল আছি বলে পাশদিয়ে কমনরুমের দিকে চলে গেল।
কি ব্যাপার নয়ন সাব কখন এলেন? বলে ক্লাশরুমে ডুকলো আমির। এইতো কিছুক্ষণ জবাব দিয়ে ক্লাশরুমে ডুকে নয়ন বলছে-
কি ব্যাপার আমির সাব ব্যাপার কি আপনার? এত সকাল বেলা আপনাকে তো পাওয়া যায় না। আজ কেন?
না এমনিতেই। বলে আমির আলী বসল বেঞ্চে।
এমনিতে মানে? কমন রুমে কি করছিলেন? একটু উচু স্বরে বলায় আমির বললো-
আস্তে কন, আপনারে বলবো সবই। এখন বলেন আপনি কেন আজ সকালেই আসছেন?
আমিও এমনিতেই, ভাল লাগছিল না। তাই ভাবলাম স্কুলে চলে যাই। বলতে বলতে নয়ন দরজা দিয়ে বাহিরের দিকে চেয়ে হাসছে দেখে আমির আলী বলছে-
কি ব্যাপার বলেন তো, আপনাকে বেশ কয়েকদিন যাবত মিনতির দিকে নজর একটু বেশি বেশি দিতে দেখছি মনে হচ্ছে?
হঠাৎ আমিরের মুখে মিনতি নামটা শুনে নয়ন অবাক হলেও কিছু বুঝতে না দিয়ে
না, এমনিতেই। মিনতিকে দেখিয়ে- দেখেন কি সুন্দর দেখা যাচ্ছে।
হুম, বুঝতে পারছি। লাগবো নাকি? যদি প্রেম করেন তো চেষ্টা করে দেখতে পারি। ভালই হবে, খারপ না। দেখতে শুনতে নায়িকার মতোই। আপনার সাথে মানাবে দারুণ।
আমিরের কথা গুলো শুনে ভালই লাগলো নয়নের। সে তো তেমনটাই চাইছে মনে মনে। তবুও কিছু বুঝতে না দিয়ে বললো –
চাইলেই কি সবকিছু পাওয়া যায়?
আপনি শুধু বলেন, লাগবো নাকি। আমিরের কথায় কেমন যেন জোড় লক্ষ্য করলো নয়ন। ভাবছে এত জোড় কোথায় পাইল আমির আলী। তাকে তো মিনতির সাথে বেশি মিশতেও দেখিনা।
দেখি, আর কিছু দিন যাক বলবো আপনাকে। এই বলে বাহির হয়ে বারান্দার জানালা দিয়ে বলল আমির সাব আমি দোকানে গেলাম। আপনি চাইলে আসতে পারেন। আমির বললো না, আপনিই যান। নয়ন দোকানের দিকে যাচ্ছে। বারান্দায় দেখা হলো ইয়াসমিন আর রেখা আসতেছে। কিছু না বলে মুচকি হেসে পাশকাটিয়ে যাচ্ছে নয়ন। রেখা বলে উঠল কই যাও, সিগারেট টানতে? রেখার কথায় লজ্জা পড়ে গেল নয়ন। আরে না এমনি তেই। হুম বলে তারা চলে গেল। নয়ন দোকানে ডুকে একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছে। তখনো নয়ন পুরোপুরি সিগারেট খায় না। মাঝে মাঝেমধ্যে টানে স্কুলে এলেই। তবে আজ যেন পাকা সিগারেট খোরের মতো টানছে। দোকানে আগে থেকেই বসা ছিল হানিফ। নয়নের সিগারেট টানার স্টাইল দেখে হানিফ বললো –
কিরে, তুই দেখা যায় সিগারেট পুরোপুরিই ধরলি। তোর পুরা নেশা হয়ে গেছে। আর ছাড়তে পারবি না দেখিস।
আরে না, সিগারেট আমার নেশা হবে না কখনো, দেখিশ। নয়ন দৃঢ়ভাবেই বলল।
দেখা যাবো।

দেখিস- বলে সিগারেটে ঘনঘন টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে একটু পানি মুখে নিয়ে গড়গড় করতে করতে আবার স্কুলের দিকে যাচ্ছে নয়ন। বারান্দয় ডুকে কমনরুমের দিকে চেয়ে দেখলো মিনতি, খালেদা মিরা আর ইয়সমিন কমনরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। নয়নের দিকে চেয়ে কি যেন বলছে আর হাসছে তারা। নয়ন এসে ক্লাশের ভিতরে বসে পড়লো। ক্লাশে আরও অনেকেই বসে আছে। প্রায় সবাই এসে পড়েছে। সবাই বই দেখছে। আলীকে জিজ্ঞাস করল কিরে আলী এখন কোন ক্লাশ? প্রথম ক্লাশ তো ইংরেজী হওয়ার কথা ছিল, ইব্ররাহীম স্যার আসেনি এখনো, দেখি কোন স্যার আসে- বললো আকরাম। আকরাম ক্লাশের সেকেন্ড বয়। লেখাপড়ায় খুবই মনোযোগী। ভাল ছাত্র। তার পাশের মাঝখানের সিটেই বসে নয়ন আর দরজার কাছে প্রথম বসে আমির আলী।

রশিদ স্যার এসে ক্লাশে ডুকলো। রশিদ স্যার বাংলা ক্লাশ নেয়। স্যারের পিছনে পিছনে মেয়েরা ডুকছে। মেয়েরা স্যারের সঙ্গেই ক্লাশে আসে আবার চলেও যায় স্যারের সঙ্গে। সবাই দাঁড়িয়ে স্যারকে সম্মান জানায়। স্যার বসতে বললেই বসে সবাই।
প্রথম বেঞ্চে বসায় প্রায় সামনে দিয়েই যেতে হয় মেয়েদের। মিনতি যখন ডুকে তখন নয়ন মুখে ফু দিয়ে মিনতির চুল উডায়। এটা প্রতিবারই করে ডুকতে ও বের হওয়ার সময়। আজও করলো। মিনতির সামনের কিছু আগলা চুল থাকতো। যা ফু দিলে উড়তো। নয়ন এতেই খুশি। ক্লাশে বারবার মিনতির দিকে তাকাতো নয়ন। সবই বুঝতো মিনতি কিন্তু কোন সময় প্রতিবাদ করতো না সে। তাই বুঝি নয়ন এসব করার সাহস পেতো। মিনতির দিকে চেয়ে আছে নয়ন। আহ! কি সুন্দর। খালেদা কাশি দিয়ে নয়নকে চোখের ইশারায় সাবধান করলো এই প্রথম। এর আগেও নয়ন এরকম করেছে। কিন্তু আজই প্রথম সাবধান করলো কেউ। দেখতো ক্লাশের সবাই, জানতোও, কিন্তু কেউ কিছু বলতো না। এমনকি মিনতিও না। স্যার হাজিরা রোল ডাকছে।

কয়েক দিন পর…..

চার পিরিয়ড শেষ, টিফিন চলছে। প্রচণ্ড গরম সেদিন। রোদ্দুর খেলা করছে চারিদিকে। সবাই এদিক সেদিক ঘুরছে, মাঠের ওপাশটায় গাছের ছায়ায় বসে আছে। নয়ন টিউবয়েলে যাচ্ছে পানি খাবে। কমনরুমের সামন দিয়ে লাইব্রেরী থেকে গ্লাস নিয়ে টিউবয়েলের কাছে যেতেই খালেদা ডাকছে-
নয়ন দাঁড়াও, গ্লাসটা দেও ধুঁয়ে দিই।
নয়ন গ্লাসটি খালেদার হাতে দিয়ে টিউবয়েলের কাছেই দাঁড়িয়ে দেখছে, খালেদা গ্লাসে পানি নিয়ে হাত দিয়েই ধুইছে।
নয়ন তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। লাইব্রেরীর কাছেই টিউবয়েল থাকায় স্যারদের শুনে ফেলার ভয়ে আস্তে আস্তেই বললো খালেদা।
আচ্ছা বল।
নয়ন বুঝতে পারছেনা কি বলতে চায় খালেদা। আগ্রহ নিয়ে শোনার অপেক্ষায় নয়ন।
খালেদা গ্লাস পরিষ্কার করে পানি ভরে নয়নের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছে-
আমি বেশকিছু দিন যাবত লক্ষ্য করছি।
কি ?
তুমি মিনতির দিকে বেশি বেশি তাকাও, ফু দাও আসতে যাইতে।
তয় কি বিচার করবা নাকি? হাসতে হাসতে বলে খালেদার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খাচ্ছে নয়ন।
না, বিচার না। মিনতিও তোমার কাজকারবার বুঝে। তুমি কি মিনতির সাথে প্রেম করবা?
নয়ন অবাক হয়ে শুনছে, আনন্দে আত্মহারা। এমন একটা কথা খালেদার মুখে শুনবে আশা না করলেও মনে মনে এমন কথা শোনার অপেক্ষা করছে অনেক দিন যাবত। কিছু বলতে পারছে না।
কি, কিছু একটা কও?
তোমারে কে বলছে এইসব?
মিনতিই বলছে, তুমি রাজি থাকলে তোমার সাথে প্রেম করতে চায় মিনতি।
আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি ওকে বলতে বলবা।
না, সে বলতে পারবে না। তুমি একটা চিঠি নিয়ে আসবা।
না, ওকেই আগে দিতে বল। আমি জানি না, কি লিখবো।
আচ্ছা, আগামীকাল সকাল সকাল স্কুলে আসবা। এই বলে খালেদা চলে গেল।

 

নয়ন-২


পানি খেতে যাওয়াটা নয়নের যেন আজ সার্থক হলো। মিনতি যে তার সাথে প্রেম করতে চায় বা মনে মনে নয়নকে পছন্দ করে এমনটা ভাবতেই নয়ন যেন আনন্দে নেচে উঠবে অবস্থা। নয়ন আজ খুব খুশি। টিফিনের পর ক্লাসগুলো কোনো রকম শেষ হতেই আনন্দে গুনগুন করে গান গাইছে আর বাড়ির রাস্তায় হাটছে। চোখে তার রাস্তার বদলে ভেসে উঠছে মিনতির মুখটি। রাস্তায় আরো ছাত্রছাত্রী উপেক্ষা করে নয়ন গান গেয়ে যাচ্ছে আপন মনে। যেন গানের মাঝেই তার হৃদয়ের আনন্দ বেরিয়ে আসছে। আনন্দে আজ যেন নাচতে ইচ্ছে করছে নয়নের, পারছেনা কেবল লোক-লজ্জার ভয়ে। তবুও মাঝেমধ্যে উচ্চ স্বরে গেয়ে উঠছে গান। গাইবেই না কেন! আজ যে নয়নের বহুদিনের জমানো স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। অনেক দিনের কল্পনা সত্যি হতে যাচ্ছে। একটা প্রেম পাওয়া নয়নের হৃদয়ের আকাঙ্খা ছিল। সেই কাঙ্ক্ষিত প্রেম পেয়ে যাচ্ছে প্রিয় মানুষটির কাছ থেকেই। মিনতি নয়নের নিত্যদিনের কল্পনা, স্বপ্ন। সেই স্বপ্নই যে সত্যি হয়েছে খালেদার কথায়। মিনতির কাছের বান্ধবীর মুখে তার আগ্রহ জেনে নয়ন আজ আকাশের চাঁদই যেন পেয়েছে হাতে। বাড়ি এসে ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লো মিন্টুর উদ্দেশ্যে, তাকে বলবে বলে। মিন্টুর কাছ থেকে পরামর্শও চাইবে। সে যে তার বাল্যকালের দোস্ত।

মিন্টুদের বাড়ি গিয়ে জানতে পারে, মিন্টু বাড়িতে নাই। কোথায় গেছে তা মা'ও বলতে পারছে না। তাই ফিরে এসে প্রতি দিনের মতো মিজানদের বাড়ির পার্শ্বে খোলা আকাশের নিচে বসে বসে ভাবছে, কি করবে। কার সাথে বলবে তার এই আনন্দের কথা, তার স্বপ্ন পূরণের কথা। নতুন নতুন প্রেম বুঝি এমনই ছটফটানি বাড়ায়। মিন্টুকে পেল না তাই মনটা একটু চিন্তিতই লাগছে। কারণ, মিন্টুই ছোট সময়ের প্রথম দোস্ত। সুখ-দুঃখ, কষ্ট বেদনা সবই তার সাথে শেয়ার করে। নয়নের মুখ দেখেই মনের কথা বুঝতে পারে সে হল মিন্টু। বন্ধু তো এমনই হওয়া উচিৎ। যদি মুখ দেখেই বন্ধুর মনের অবস্থা না বলতে পারে তবে কিসের বন্ধু। মিন্টুকে না পেয়ে কিছুই যেন ভাল লাগছে না। কোথাও আর স্থির হয়ে থাকতে পারছেনা নয়ন। ভেতরের আনন্দ যেন আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতোই বেরিয়ে আসতে চাইছে। একা মনে বসে গান গাইছে......

আসাদ আসছে দেখে নয়নের গান একটু ছোট হয়ে এলো। আসাদ দূর থেকেই বলছে- কিরে আজ বিকাল বেলাই আসর শুরু করে দিলি। কয়েক বন্ধু মিলে প্রতি রাতেই এখানে বসে আড্ডা দেয়, মাঝেমধ্যে গান গায় তারা। তাই আসাদ একটু ব্যঙ্গ করেই বললো হয় তো। আসাদ নয়নের ভাতিজা লাগে সম্পর্কে। বয়সে সমবয়সী বলে বন্ধুর মতোইর চলাফেরা তাদের মধ্যে। সবকিছুই ওরা কয়েকজন একসাথেই করে। নয়ন গান থামিয়ে আসাদকে কাছে ডাকলো- এই দিকে আয় তাড়াতাড়ি, তোর সাথে কিছু কথা বলার আছে।
আসাদ হাসতে হাসতে নয়নের পাশে এসে ঘাসের উপর বসতে বসতে বলছে- কিরে, আজ তোরে এতো খুশি খুশি মনে হচ্ছে, কারণ কি?
হুম, আজ আমার খুব আনন্দের দিন। আমার এত্ত দিনের স্বপ্ন আজ বাস্তবতার ছোঁয়া দিয়েছে।
কি এমন পেলি যে, এত্ত আনন্দ। আর স্বপ্নটাই বা কি? প্রেমের সঙ্গী খুঁজে পেলি না কি?
হুম, অনেকটা সেরকমই।
কে?
তুই মিনতিকে দেখসছ?
আসাদ নয়নদের স্কুল পেরিয়ে তার মাদ্রাসায় যায়। অনেক সময় নয়নদের স্কুলের সামনে দোকানে বসে আড্ডা দেয়। তাই অনেক মেয়েদেরই আসাদও চিনে। আসাদ বললো-
কোন মিনতি, ওই বিলাই চোইক্ষ্যা, বাঘের চর থাকে সেই মিনতি?
জানিনা কোথায় থাকে। তবে ওই দিক থেকেই আসে দেখি। তুই কি তারে দেখছস কোনোদিন?
হুম, দেখেছি। খুব সুন্দরী। স্কুলের অনেক ছেলেই তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে অনেকেই হয় তো তার সাথে প্রেম করার জন্যও পাগল। কেন, মিনতির কি হইছে?
আসাদের মুখে মিনতির প্রশংসা শুনে আর মনে মনে আনন্দে নাচতে লাগলো নয়ন। না, মানে, আজ খালেদা বললো মিনতি নাকি আমার সাথে প্রেম করতে চায়। তুই কি কস। ভাল হবে তার সাথে আমার প্রেম করা।
কেন ভাল হবে না। মেয়ে তো দেখতে শুনতে ভালই। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তোর কথা।
তোর বিশ্বাস করতে হবে না, তুই শুধু বল কেমন হবে।
তুই কি তার বাড়ি চিনস? আসাদ কেমন যেন একটু চিন্তিত হয়েই বলল।
না, চিনি না।
তাইলে কেমনে, বাড়ি-ঘর না জেনেই প্রেমে পড়া কি ঠিক হবো। আসাদ কেমন যেন হঠাৎ আমার গার্ডিয়ানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হল।
আমি বললাম- তার বাড়ি ঘর জেনে কি করবো। আমার তো শুধু ওকেই দরকার। আমার এতদিনের স্বপ্ন ওর সাথে প্রেম করা। ও যেদিন প্রথম আমাদের স্কুলে এসে ভর্তি হয়েছিল, সেদিন থেকেই তাকে দেখার পর আমার মনের ভেতর প্রেমের আকাঙ্খা জন্মেছে। এতদিন মুখে বলতে পারিনি কিছুই। শুধু দেখেছি দুচোখ ভরে। কেবল মনে মনে স্বপ্ন সাজিয়েছি। একা একা মনে মনে তার সাথে কথা বলেছি। মনে প্রাণে চেয়েছি একান্ত আপন করে। আজ সেই চাওয়া আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে।

এবার আসাদ একটু হাসি হাসি মুখেই বলল- কি হয়েছে, আমাকে ভালো করে বল শুনি।
আজ খালেদা সিওর করে বললো-মিনতি আমার সাথে প্রেম করতে চায়। আমাকে নাকি চিঠি দেওয়ার কথা বলেছে।
তুই কি বললি?
আমি বলেছি, আগে তাকেই চিঠি নিয়ে আসতে বলো।
ঠিক বলছস। আগে ওই'ই চিঠি দেক। তারপর না হয়.....।
হুম, তাই বলেছি। 

তাদের কথা বলার সময় আল-আমিন আসলো। পাশে এসে নয়ন ও আসাদকে হাসি খুশি দেখে বলছে- কিরে.... তোরা এত্ত খুশি ক্যারে আজ। আল-আমিন নয়নের ক্লাসেই পড়ে। আজ স্কুলে যায়নি। তাই নয়নকে দেখে বলছে, আজ স্কুলে গিয়েছিলি?
হুম, গিয়েছিলাম। আজ একটা মজার কাহিনী হয়ে গেল স্কুলে।
কি হয়েছে শুনি। নয়ন স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে খালেদার সাথে কথা বলার সব কিছুই বললো। আল-আমিন সবকিছু শুনে কোনো কথা না বলে সোজা সুজি বলে দিল- কোন চিন্তা নেই, শুরু করে দে। এমন মেয়ের সাথে প্রেমে পরা সৌভাগ্যের।

তাদের কথা বলার মাঝেই মিন্টুকে দেখা যাচ্ছে এদিকেই আসছে। মিন্টুকে দেখেই আল-আমিন বলছে- ওই তো মিন্টু আসছে। ও আজ কই গেছিলো। আমি বললাম- জানিনা, আজ স্কুলেও যায়নি। মিন্টু কাছাকাছি আসতেই আল-আমিন বলছে- কিরে, আজ তুই কই ছিলি। মিন্টু বলল- একটু ধানুপাড়া গেছিলাম। ধানুপাড়া মিন্টুর নানু বাড়ি। মিন্টুকে দেখেই আসাদ হেসে হেসে বলছে- নয়ন তো আজ বেজায় খুশি।
কেন রে, আজ কি পাইলি। আমাকে লক্ষ্য করে বললো মিন্টু। মিন্টুকেও সবকিছু খুলে বলে, শেষে বললাম এখন কি করি, আমাকে তোরা বোঝা। তোর বাড়িতে খুঁজে এসেছি। তুই আসছস ভালই হইছে।
মিন্টু কোনো চিন্তা না করেই বলে দিল- এতে আর চিন্তা করার কি আছে। মিনতি আপার মতো মেয়ে কারো প্রেমে পড়তে চাইলে যে কেউ আনন্দে আত্মহারা হবে। তাছাড়া, তোর তো আশা পূর্ণই হচ্ছে।
হুম, তা ঠিক বলছস। আমার আশা পূর্ণ হওয়ার পথে। তাহলে.... দেখি ও চিঠিতে কি লেখে, তার পর আমি উত্তর দেবো। এই বলে নয়ন ওঠে বাড়ির দিকে হাটতে লাগলো। কিরে, কই যাস। আল-আমিন বললো। আমি মাথা ব্যথা করছে বলে, চলে এলাম।

আমার রুমে এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি- কি লিখবে মিনতি প্রথম চিঠিতে। আমিই বা কি লিখবো। আমি তো কোন চিঠি লিখিনি। ভাবতে ভাবতে কেমন যেন লজ্জা লাগতে শুরু করলো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, তাই বাতি জ্বালিয়ে টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে আছি। খুব টেনশন হচ্ছে। একটা বিড়ি ধরিয়ে টানছি। এই সময় আম্মা সাধারণত রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই একটু আয়েস করেই টানছি আর ভাবছি আগামীকাল কি বলবো। কখন যে আম্মা ও ঘর থেকে আমার বিড়ি খাওয়া দেখে ফেলেছে বুঝতেই পারিনি। চৈতন্য ফেরে আম্মা যখন বলছে, এই নয়ন, কি এমন চিন্তা করছস। বিড়ি খাওয়ার সিস্টেম কি। যেন সংসারের কঠিন চিন্তায় মগ্ন। হারাম জাদা, পড়া বাদ দিয়ে বসে বসে বিড়ি খাওয়া। আমি তাড়াতাড়ি বিড়ি ফেলে দিয়ে বললাম- কই, না- কিছু না। আম্মা চলে গেছে ততক্ষণে। মনে মনে নিজেদের উপর রাগ হচ্ছে। কয়েক দিন চিন্তা করেও আমার রুমের পার্টিশনে কয়োটি পেপার লাগাবো লাগাবো বলেও লাগাতে পারিনি। লাগালে আজ আম্মার কাছে ধরা খেতে হতো না। আসলে কাজ কখনো পরে করবো বলে ফেলে রাখতে নেই।

না, আজ কিছুতেই ভালো লাগছে না। মন চাইছে কখন সকাল হবে। মিনতির চিঠি পড়বো। চোখে যেন মিনতি- শুধুই মিনতির মুখটা ভাসছে। মনে কেবল ওকে নিয়েই নানা ধরণের চিন্তা। মিনতি আসবে- হাতে একটা চিঠি থাকবে। মুখে মিষ্টি মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলবে- আই লাভ ইউ নয়ন। আমার হাতে চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলবে- আগামীকাল চিঠির উত্তর নিয়ে আসবে। তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকবো। আমি চিঠি পকেটে রেখে মিনতিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলবো- আই লাভ ইউ টু মিনতি। তুমি আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। তুমি শুধু আমাকে মনে রেখো, ধরে রেখো তোমার বাহুডোরে, ভালোবাসার বন্ধনে সারাটি জীবন জুড়ে। আমি তোমার সাথেই বাঁচবো, মরতে হলে মরবো তোমার সাথেই।

এরকম কতশত কথা মনের ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছে। কত মধুর মুহূর্তের চিন্তায় মগ্ন এই মন। প্রথম প্রেমের প্রথম চিঠি বলে কথা। আমার কিশোর হৃদয়ের স্বপ্ন স্বাদ পূরণ হওয়ার পথে। তাই আনন্দ আর অজানা ভয়ে অস্থির লাগছে। রাতে ভাত ভালো লাগলো না। তবুও আম্মার জোড়াজুড়িতে অল্প কিছু ভাত খেতেই হলো। মা কোনো মতেই ভাত না খেয়ে ঘুমোতে দিতে পারেনা। মা আমার! সব সময় খাওয়ার সময় থাল ভরে ভাত দিতো আর বলতো- সব গুলোই খাবি, ভাত পাতে রাখতে নেই। মা যেন পেট ভরে ভাত খাওয়াতে পারলেই তৃপ্তি পায়। মা'রা বুঝি এমনই হয়।

সেই রাতে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি জানিনা। ঘুম ভাঙল আম্মার ডাকে- নয়ন, এই নয়ন উঠ না....। গোছল করবি ভাত খাবি স্কুলে যাবি। কখন উঠবি, এই নয়ন ওঠ। তোর বাপে আইলে কিন্তু মারবো। তাড়াতাড়ি ওঠ, হাত-মুখ ধোয়ে পড়তে বস। ঘুম ভাঙতেই আমি বিছানা ছেড়ে দাত ব্রাশ করতে করতে বাহিরে এসে প্রস্রাব করে হাত মুখ ধোয়ে মা কে বললাম- আম্মা ঠাণ্ডা ভাত নাই। মা বলল- ঠাণ্ডা ভাত কেন, গরম ভাতই হয়ে গেছে। তুই গোছল করে আয়- নয়টা বেজে গেল প্রায় আমারও অফিসে যেতে হবে, তুই আসতে আসতে তরকারি হয়ে যাবে.....। 

আম্মা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এর ভিজিটর। প্রতিদিন সকালে আমাদের তিন ভাইকে খাইয়ে নিজেও খেয়ে অফিসে যায়। গ্রামের সংসার সামলিয়ে অফিস করা আম্মার খুব কষ্ট হয়ে যেতো, তবুও কোনদিন অনিয়ম হতো না। আমাদের কোনো বোন না থাকায় মা'র কষ্ট আরও বেশি। একটা বোন থাকলে আম্মাকে সামান্য সাহায্য সহযোগিতা করতে পারতো। পাশের বাড়ির বিমলা ফুফু মাঝে মাঝে আম্মাকে সাংসারিক কাজে সহযোগিতা করতো। বিনিময়ে আমাদের ওখানেই খেতো। বিমলা ফুফু খুব দুঃখী। একটা ছেলে আছে তার আমার সমবয়সী। স্বামী পরিত্যাগ হয়ে নিজের বাপের বাড়িতেই সামান্য একটা ঘর তোলে থাকেন। এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে নিজে চলতো আর ছেলেকে খাওয়াতো। আমাদের পুরাতন জামাকাপড় তার ছেলেকে পড়তে দিতাম। মাঝেমধ্যে মানে ধান কাটামারির সময় দেখতাম ফুফুকে নতুন কাপড় কিনে দিতো, জাম্বু ( বেলাল) কেও। বিমলা জিয়ের ছেলের নাম বেলাল। সবাই জাম্বু বলেই ডাকতো। খুব সুন্দর চেহারা জাম্বুর। জাম্বু এখন বড় হইছে। মানুষের বাড়িতে বছর চুক্তি কাজ করে। অল্প কিছু যা মাইনা পায় তা দিয়েই তারা মা-ছেলে চলে।

আমি তাড়াতাড়ি গোসল করে এসে আম্মাকে ডাকছি ভাত খাবো বলে। আম্মা আমাকে সবসময় খাওয়ার সময় ভাত বেড়ে দিতো, তবেই খাইতাম। আম্মাকে ছাড়া ভাত খাইতে একদম ভালো লাগতো না। আম্মা এসে প্লেট ধুয়ে যথারীতি থাল ভরে ভাত বেড়ে দিয়ে বলল- তরকারি পাতিল থেকে নিয়ে খা। আমি রেড়ি হই, অফিসে যেতে হবে- আমার তাড়াতাড়ি। মা গোসল করতে গেলে আমি অর্ধেক খেয়ে আর অর্ধেক ভাত পাতিলে নামিয়ে রেখে কোনোরকম হাত ধুয়ে চলে এলাম আমার রুমে।

মনে মনে খুব আনন্দ আজ। কিছুক্ষণ পরই আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে দেখা হবে। কোন শার্ট পড়বো, পেন্ট কোনটা এই ভাবতে লাগলাম। প্রথম সাক্ষাত বলে কথা। দেখাতো প্রতি দিনই হয়, তবুও আজকের হিসেবটা ভিন্ন, আজকের দেখাটা আলাদা তাৎপর্যপূর্ণ। তাই মোটামুটি চিন্তায় পড়ে গেলাম কোন শার্টটি পড়বো। যাক, শেষে নূর ভাইয়ের দেওয়া হলুদ শার্ট আর আমার সবচেয়ে মনেরমত পেন্টটি পড়ে বই খাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্কুলে যাওয়ার জন্য। স্কুলে পৌঁছলাম তখন মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে।

আজ স্কুলে আমিই মনে হয় প্রথম এসেছি। কেউ নেই। এতবড় স্কুলে একা একা কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। জানালার পাশে একটি বেঞ্চে বসে আছি। মিনতি যে পথে স্কুলে আসে, সেই পথের দিকে চেয়ে....। ভাবছি একা মনে অনেক কিছুই। এত ভাবনার মাঝে আমার কখনওই মনে হল না আমার হয় তো ভুল হচ্ছে। ভালোবাসা পাওয়ার ব্যাকুলতা আমাকে ঘিরে রেখেছিল। আজ সেই ব্যাকুলতারই অবসান হচ্ছে। মনের মধ্যে এ যে কেমন অনুভূতি তা বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

কিছুক্ষণ পরই দেখলাম মিনতি আসছে। দূর থেকে দেখেই আমার চোখ পাগল হয়ে গেল। খুব সুন্দর লাগছে আজ। প্রতিদিনই দেখি, মনে হয় খুব সুন্দর। কিন্তু, আজ যেন বেশিই সুন্দর দেখছি। মিনতি এত সকাল সকাল কোনদিন স্কুলে আসেনি। আজ একটু তাড়াতাড়িই এসেছে। কারণটা মনে হয়- প্রথম প্রেম পত্র। মিনতিকে আসতে দেখেই আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। মিনতি আসছে ধীরেধীরে এগিয়ে। আমাকে দেখেই মনে হয় তার মুখে মিষ্টি হাসি। কপালে ছাড়া চুলগুলি বাতাসে দোলছে। আহ! নিজেকে আজ খুব সৌভাগ্যবান মনে হতে লাগলো এই ভেবে যে, এত সুন্দর একটা মেয়ে আমাকে ভালোবাসে! আমি সত্যিই আজ যেন মহাসুখ অনুভব করছি। নিজেকে সুখী ভাবছি।

মিনতি এসে সোজা কমনরুমে ঢোকে বই রেখে আবার বেরিয়ে এলো। সোজা আমার দিকে। আমি তার আসা দেখে ক্লাসে ঢোকলাম। মিনতি আমার কাছে এসে বুকের ভেতর রাখা একটা চিঠি (কাগজ ভাজ করা) আর তার একটা ছোট সাদাকালো হাফ ছবি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো- আগামী কাল চিঠির উত্তর যেন পাই। যেন ভুল না হয়। এই বলে চলে যেতে ফিরতেই আমি বললাম দাঁড়াও, কিছুক্ষণ থাকো না।
না, কেউ দেখে ফেললে আমার বাড়িতে এই খবর চলে যাবে। তখন আমার মায়ের হাতে মার খেতে হবে।
তবুও কিছুক্ষণ থাকো না। এখন তো আর কেউ নেই।

মিনতি হাসছে মৃদু। না না আমার এত আদরের দরকার নাই। মুচকি হেসে আবারও ফেরত চিঠির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না তাকে। মনে মনে কতই না কথা সাজিয়ে রেখে ছিলাম মিনতিকে সাক্ষাতে বলবো বলে- সেইসব কথার কিছুই বলা হলো না। ওর মুখপানে চেয়ে থেকে আর তার কথা শুনেই পার হয়ে গেল বহু কাঙ্ক্ষিত সময়। চিঠিটি পকেটে রেখে ছবিটি আরেকটু দেখলাম। তার পর ছবি পকেটে রেখে ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়লাম চিঠি পড়ার জন্য নিরিবিলি জায়গার সন্ধানে.....।

 

নয়ন-৩ 



অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণের পত্র বুক পকেটে নিয়ে নিয়ে ঘুরছে নয়ন। নিরিবিলি একটা জায়গার দরকার, কেউ যেনো না দেখে। প্রথম প্রেমের প্রথম চিঠি। বুকে একটা দুরুদুরু ভাব, ভয়ের কিছু নেই, তবুও কেমন লজ্জা লাগছে নয়নের। তাই আগে থেকেই সাবধান থাকার চেষ্টা। তখন সবেমাত্র দশটা বাজে। ক্লাস শুরু হতে এখনো আধাঘন্টা। তা ভেবেই সাহেব আলীদের বাড়ির দিকে হাটছে নয়ন। বাড়িটি স্কুলের সাইডেই, সবার অবাধ চলাফেরা সেই বাড়িতে। সাহবে আলীর বাবা ফকির মিঞা সে স্কুলেরই পাহারাদারের চাকরি করে। খুব ভালো মানুষ। নয়নের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক। নয়নকে খুব ভালোও বাসে হয়তো। এই ভালোবাসা স্কুলে নয়নে উম্মুক্ত চলাফেরা আর তারচেয়েও বড় কথা নয়ের মা তার বাড়ির পঞ্চাশ গজ দূরেই ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এর ভিজিটর (মহিলা ডাক্তার)। সেই সুবাদে নয়নকে সবাই একটু বেশিই আদরে দেখে। হাসপাতাল কোয়ার্টারেও থেকেছে নয়ন তার মার সাথে ছোট সময়। তখন থেকেই নয়নকে ওরা ভালোবাসে। যাহোক, মিনতির চিঠি পড়ার উপযুক্ত জায়গা সাহেব আলীদের ইন্দিরা পাড় ভেবে সে দিকেই যাচ্ছে। কারণ, এই সময় কেউ সে বাড়িতে যাবে না।

নয়ন সেই বাড়িতে ঢুকে সোজা কুয়াঁর কাছে চলে গেল। কুয়াঁর চারপাশ নানা ধরণের গাছগাছড়ায় ভরা। পিছনের ছাইট খুবই ঘন জঙ্গল। কুয়াঁর সঙ্গে দুটি জবা ফুলের গাছ। খুব সুন্দর সুন্দর লাল লাল জবা ফুল ফোটে আছে গাছে। দারুণ একটা জায়গা ভালো লাগার মতো। কুয়াঁর পাশে একটা গাছ হেলে প্রায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া অবস্থা। গত ঝড়ে মনে হয়ে হয় শেকড় উপড়ে পড়েছিল, সেটি আর সরানো হয়নি। সেই গাছের উপর বসেই নয়ন ধীরেধীরে বুক পকেট থেকে মিনতির প্রথম প্রেমপত্র বের করে পড়ছে। চোখে মুখে মুগ্ধতার ছাপ স্পষ্টত। মনের খুশিতে হাসি হাসি মুখে চিঠি পড়ছে নয়ন। আহ! সে কি আনন্দের মুহূর্ত! মনে হচ্ছে কত সহস্র বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণের তৃপ্ততা! খুব সুন্দর করে মেয়েলি হাতের লেখা পড়ছে আর ভাবছে মাঝেমধ্যে। একটু ভাবতেই হচ্ছে কারণ, অনেক বানানই ভুল, সেগুলো মিলাতেই ভাবতে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি লিখেছে মা বোনের চোখ ফাকি দিয়ে, তাই বানানের ভুল গুলি মিনতির চোখে পড়েনি হয় তো। যাক, সেগুলো নয়ন ঠিকই বোঝতে পারছে। প্রেমিক যারা তারা প্রেমিকার অনেক কিছুই বোঝতে পারে ঠারেঠোরে। নয়নও বোঝে নিচ্ছে।

নয়নের আনন্দ ভাবনার মাঝে কখন যে সাহেব আলীর মা এসে পাশে দাঁড়িয়ে আছে নয়ন টেরই পায়নি। ধ্যান ভাঙে যখন বলছে, 'ওরে গোলাম, স্কুলে এসে এগুলো করা হচ্ছে?' হঠাত নয়ন এমন কথা শুনে হকচকিয়ে বলছে, না না তেমন কিছুনা, এই তো এখনই আসলাম, চলে যাবো। তাড়াতাড়ি যা, এই বলে সাহেব আলীর মা কোঁয়া থেকে পানি তুলতে চেষ্টা করছে। এতক্ষণে নয়ন বোঝতে পারছে এখানে কেন এসেছে। যাচ্ছি বলে নয়ন জবা গাছের হেলে থাকা ডাল থেকে দুটি জবা ফুল ছিড়ে হাতে নিয়ে আবার স্কুলের দিকে রওয়ানা দিল। বাড়ি থেকে বের হতেই দেখে অ্যাসেম্বলি লাইন দাঁড়িয়ে গেছে। তাই একটু অপেক্ষা করছে সেই বাড়িতেই। অ্যাসেম্বলি শেষ হলেই আসবে ভেবে। কিন্তু, মনে কেমন যেনো একটা চিন্তা। অ্যাসেম্বলিতে তো তাকে খুঁজবে। কারণ, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার তিন জনের মধ্যে একজন তো নয়নই। নয়ন একটু গানবাজনা প্রিয়, গায়ও বেশ চমৎকার, কণ্ঠও মোটামুটি ভালোই। তাই প্রতিদিন অ্যাসেম্বলিতে নয়নের উপস্থিত থাকতেই হয়। না হলে সবাই খোঁজে, কারণ, কেউ সামনে গিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে চায় না। যা হোক, আজ নয়ন অ্যাসেম্বলিতো জোগ দিবে না ভাবছে। কারণ, হাতের জবা ফুল দুটি তার ক্লাস পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সখ হয়েছে। অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়ালে ফুল পকেটে রাখতে হবে, নষ্ট হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাসেম্বলি শেষ হলো, সবাই যার যার ক্লাসরুমে চলে গেল। নয়নও হাতে দুটি জবা নিয়ে ক্লাসে ঢুকছে। আমীর সাব মনে হয় কিছুটা বোঝেই ফেলেছে। তার বোঝার খুব একটা কারণও আছে হয় তো। যাক সে কারণ আর বলছি না। সেটা গোপনই থাকুক, যেহেতু তখনও প্রকাশ হয়নি আমার কাছে।
কি ব্যাপার নয়ন সাব কোথায় ছিলেন অ্যাসেম্বলির সময়? স্যার আপনাকে খুঁজেছে। আমীর এর কথা শেষ না হতেই আক্রাম বলে ওঠলো কি ব্যাপার নয়ন, ( মুখে মুচকি হাসি নিয়ে) অ্যাসেম্বলিতে গড়হাজির, হাতে ফুল, কই ছিলা তুমি? নয়ন মুচকি হেসে জবাব দিল, আরে না তেমন কিছুই না, ফকির ভাইয়ের বাড়ির দিকে গেছিলাম। হাতের কাছে ফুল দেখে লোভ সামলাতে পরলাম না, তাই দুটো নিয়েই ফিরলাম। দেখি অ্যাসেম্বলি দাঁড়িয়ে গেছে তাই আর আসিনি।
সবাই একটু মুচকি হেসে নিল, মোটো আকরাম বলেই ফেললো, মনে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে তাই....
নয়ন মুখে কিছু না বলে একটু মুচকি হেসে ব্র্যাঞ্চে বসে পড়লো। ফুল দুটো বইয়ের পাশেই রাখা। 

মেয়েরা ক্লাসে ঢুকছে, স্যার সম্ভবত তাদের ক্লাসে যেতে বলে তিনি পাশের ক্লাশের স্যারের সাথে আলাপ করছে। খালেদার দিকে প্রথমেই তাকালো নয়ন, চোখ দিয়েই বুঝিয়ে দিল যে হ্যা, মিনতি চিঠি দিয়েছে। মিনতি চুপচাপ নিচের দিকে চেয়ে আছে। মনে হয় একটু লজ্জাই পাচ্ছে। লজ্জায় সাদা মুখটা যেন জ্বাল করা দুধের মতো লাল দেখাচ্ছে। স্যার না আসায় নয়ন খালেদার দিকে দুটো ফুলই বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, ধরো, তোমাদের শুভেচ্ছা দিলাম জবা ফুলের। খালেদা মুচকি হেসে ফুল দুটি নিয়ে একটা মিনতির সামনে রেখে দিল। মিরা আর ইয়াসমিন বলে ওঠলো মাত্র দুটি! আমরা কি দোষ করলাম? ভাগ্যিস সেদিন রেখা আসেনি, না হলে আরও কিছু শুনতে হতো, রেখা মেয়েটা খুবই পটু কথাবার্তায়। হ্যা হ্যা, সবাইকে দেবো একদিন। সবাইকে শুভেচ্ছা রইল আজ, ফুল আরেকদিন দিবো পাওনা রইলা। ফুল লোকানো দেখেই দরজার দিকে তাকাইলো নয়ন। স্যার ঢুকে পড়েছে ক্লাসে। সেদিনের মতো আনন্দেই পার হলো স্কুল সময়। 
স্কুল ছুটি হয়ে গেল। নয়ন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে। চোখ দুটো যে তার মিনতিকেই খুঁজছে। খালেদা পাশা দিয়ে যাওয়ার সময় চুপিচাপি বলে গেল, আগামীকাল যেন মিস না হয়, মনে রেখো। নয়নও স্কুল থেকে সবার সাথেই বেরিয়ে পড়লো।

প্রথম প্রেমের প্রথম স্বাদ প্রথম চিঠি। কিযে আনন্দের তা যারা প্রথম প্রথম প্রেমে পড়ে তারাই বোঝে। নয়ন আজ বেজাই খুশি। অন্যান্য দিনের মতো খুশিতে আজ কোন গান টান গাইছে না। কি যেন ভাবছে, খুব গম্ভীর একটা ভাব, চোখে মুখে কোন একটা চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়তো। তাই তো মিন্টু দেখা হতেই বললো, কিরে কি হয়েছে, খুব চিন্তা দেখছি?
মিন্টু ছেলেটা এরকমই, মুখ দেখেই বোঝে যায় সব। হুম, কিছু একটা তো হয়েছেরে।
কি হয়েছে সেটা বল, একটু শুনি। দেখি কিছু করতে পারি কিনা।
তুই আর কি করবি, যা করার তো আমাকেই করতে হবে।
হুম, তুইই তো করবি, আমিও না হয় একটু শুনি। মিনতি আপা চিঠি দেওয়ার কথা ছিল আজ, দিয়েছে ?
হুম, সেটাই তো ভাবছিরে মিন্টু....! প্রেমটা মনে হয় হয়েই গেল।
ভালোই তো হলো তাহলে, তোর তো এমনটাই চাওয়া ছিল।
হ্যা, তা ছিল। তবুও কেমন যেন আনন্দের মাঝেও আমার কি একটা দুশ্চিন্তা লাগছে। আমাকে মন থেকে ভালোবাসবে তো? আমার খুব আনন্দ যেমন হচ্ছে, তেমনি কেমন যেন একটা ভাবনায় গম্ভীরতা আসছে। কি হবে!
কিচ্ছু হবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবি।
কথাটা এমনভাবে বললি যেন তুই আগে অনেকগুলো প্রেম করেছিলি।
প্রেম করা লাগবে কেন, কয়েক জনের প্রেম তো দেখেছি, তাতেই একটা ধারণা মাত্র।
হুম, বুঝছি, খুব শেয়ানা তুই, দেখেই বুঝে যাস সবকিছু। খুব পাকনা। হা হা হা।
এতে হাসার কি হইল।
হাসবো না ?
না, হাসবি না। কারণ, তোর চেয়ে প্রেম প্রেম খেলা আমি বেশি দেখেছি। এবার আসল কথা বল। মিনতি কি লেখছে চিঠিতে।
হুম, লেখছে তো অনেক কিছুই।
কই দেখি, আমাকে দেখা কি লেখছে।
না না, সেটা দেখাবো না কাওকে। এর পর থেকে দেখিস। এটা আমি আমার মানের ঘরে রেখেদিবো যতনে। কাউকে দেখাবো না। মনে মনে ভাবছে, আসলে চিঠির মধ্যে খুব বেশি ভুল। কোন কোন শব্দে শেষ অক্ষরই নাই। এমন চিঠি দেখাতে নয়নের এটু লজ্জা লাগছিল। তাই আর দেখাবেনা কাউকে এমনটাই চিন্তা ভাবনা।
ও ও আচ্ছা, তো মজ্নু সাব কন দেহি, কি কি লেখছে। একটু শুনা, শুনে ধন্য হই।
দুর বোকা, সেটা কি মুখে ওতো টা বলা যায়। তবে, সে নাকি আমাকে অনেক দিন থেকেই ভালোবাসে, বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারেনি।
হুম, প্রথম প্রথম এমনই বলে।
কি ?
না, কিছুনা, হবে হয় তো। আচ্ছা, মিনতি আপা ক্লাস এইটে ভর্তি হয়েছে না?
হুম, ঠিক বলেছস। সেই প্রথম থেকেই নাকি আমাকে নজরে নজরে রেখেছে। 
হুম, বোঝতে পারছি। এখন তুই কি লেখলি।
না, আমি এখনও লেখিনি। রাত্রে লেখবো। একটা ছবিও দিতে বলেছে। 
ও, আচ্ছা রাত্রে লেখবি একা একা মনের ভাব মিশিয়ে। চেষ্টা কর, যেমনই হোক। তোর ছবি তোলা নেই?
না, আমার কোন ছবি তো বর্তমানে তোলা নেই। তবে হাফ সাদাকালো আছে একটা।
সেটাই দিবি সমস্যা কি। সে ছবি দিয়েছে?
হুম, একটা সাদাকালো হাফ ছবি দিয়েছে। এই বলে মিনতির ছবিটি মিন্টুর দিকে বাড়িয়ে দিল।
হুম, খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে। আসলে সুন্দর মানুষ তো, ছবিও সুন্দর হয়েছে। ছবিটি দেখে আবার আমার হাতে দিয়ে বলছে, তুই থাক, সন্ধ্যে হয়ে যাবে, আমি এখন একটি দহিন পাড়া যাবো। রাত্রে কথা হবে। বলেই মিন্টু চলে গেল কাঠাল তলির দিকে।

আমি কিছুক্ষণ ওখানে বসেই থাকলাম। সন্ধ্যার ঠিক কিছুক্ষণ বাকি। সূর্য ঢুবেই গেছে। তবে আলো এখনো আছে। মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে নয়ন মিনতির সাথে কথা বলছে। অনেক কথা, অনেক স্বপ্ন তার চোখে ভেসে ওঠছে। জানিনা কোনদিন সেই সব কথা বলতে পারবো কিনা, সেইসব স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা। নাকি স্বপ্নগুলো সব স্বপ্ন হয়েই মনের আকাশে ভেসে বেড়াবে। দেখতে দেখতে হাল্কা অন্ধকার নেমে এলো। এবার ওঠতেই হবে। ক্লাসের পড়া মুখস্থ করতে হবে। অংক করতে হবে। আবার মিনতির জন্য একটা চিঠিও লিখতে হবে। অনেক কাজ আজ নয়নের। তাই সেখান থেকে ওঠে বাড়ির দিকে হাটছে নয়ন।

বাড়ি দহলে আসতেই আল আমিনের সাথে দেখা। আল আমিন হয়তো পশ্চিম পাড়া তার বোনের বাড়িতে গেছিলো। ওতো সেদিকেই বেশি যায়। কিরে, কই থাইক্কা আইলি সন্ধ্যা সময়।
নয়নকে দেখে আল আমিন দাঁড়িয়েই ছিল। এই তো বিকেলে একটু বুবুদের বাড়িতে গেছিলাম। কি খবর তোর।
না, কোন খবর নেই, ভালই। এখন কিছু পড়া আছে, বিএসসি স্যারের একটা অংক আছে সেগুলো করতে হবে।
ও আচ্ছা, থাক তাইলে, বাড়ি যাই। আমারও আজ কিছু পড়ার চাপ আছে। এই বলে আল আমিন চলে গেল। নয়ন তার রুমে ঢুকে চেয়ারে বসে আছে, কুপি বাতি জ্বালিয়ে। গ্রামের বাড়ি। তখনও বিদ্যুৎ আসেনি গ্রামে। কুপি বাতি না হয় হারিকেন জ্বালিয়েই পড়তে হয়। আজ হারিকেন না জ্বালিয়ে কুপি বাতিই জ্বালালো নয়ন। হারিকেনের চিমনি একটু কালি হয়েছে। বিকেলে মুছা হয়নি। এখন আর মুছতে ইচ্ছে হলো না। 
চেয়ারে বসে বসে ভাবছে কি করবে। আগে চিঠি লিখতে বসবে নাকি পড়া শেষ করবে। ভাবতে ভাবতে আগে পড়া নিয়েই বসে পড়লো নয়ন। পড়া আগে মুখস্থ করতে হবে, নয়তো ক্লাসে লজ্জা পেতে হবে। নতুন প্রিয়তমার সামনে লজ্জা পেতে রাজি না। খুব মনোযোগী হয়েই পড়ছে নয়ন। অল্প সময়েই কয়েকটি বইয়ের কয়েকটি প্রশ্ন মুখস্থ হয়ে গেল নয়নের। অংকটা বাকি। ভাবছে অংকটিও করেই খাইতে যাবে। তাই অংক বই বের করে অংক করতে বসলো। এমন সময় মা ওই ঘর থেকে ডাকছে, নয়ন... ভাত খেয়ে যা। নয়ন, অংক করতে করতেই জবাব দিল আসছি, আর একটু, অংকটা করেই আসছি। অংকটা শেষমেশ আর হলো না। প্রথমবার ভুল হওয়াতে সরল অংক গড়ল হয়ে গেছে। দুই তিনবার করেও যখন মিলছে না। কেমনে মিলবে, খাতার পাতায় অংকের বদলে মিনতির বিচরণ। বারবার মিনতিকেই দেখছে সে। না আর মিলবে না মনে হচ্ছে, তখন স্কুলে গিয়ে আমীর আলীর খাতা দেখে তুলে নেওয়ার কথা ভেবেই ওঠে ভাত খেতে চলে গেল।

রাত প্রায় এগারোটা ছোঁয় ছোঁয়। গ্রামের নীরব স্তব্ধ রাত। বেশিরভাগ বাড়ির মানুষই কাঁচা ঘুমে মত্ত এখন। এই সময় নয়নের বাড়ির সামনে পায়ে হাটা পথের ধারে আড্ডায় থাকার কথা বন্ধুদের সাথে। প্রতিদিনই তো তা'ই করে নয়ন। রাত দশটা সেড়ে দশটা থেকে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত চলে তাদের গান আর রাত্রি পাহারা। বাড়িতে থাকলে এমনটিই হয়ে থাকে প্রতিদিন। আজ ব্যতিক্রম হয়ে গেলো। নয়ন কুপির মিষ্টি আলোয় টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে কলম হাতে খাতার পাতা শেষ করে চলেছে, একটা চিঠি লিখতে পারছেনা। লিখতে পারছেনা বলতে, হচ্ছে না মনের মতো। বারবার লেখছে আর ছিড়ছে। একসময় হয়েছে মনের মতো কোনোরকম। ভাবছে থাকুক আজ এ পর্যন্তই। পরের চিঠিতে লেখবো। চিঠিটা লিখে সুন্দর করে ভাঁজ করে বইয়ের মাঝে রেখে বাহিরে চলে এলো নয়ন।

বাহিরে ঝিরঝির ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আকাশটাও পরিষ্কার। অর্ধচন্দ্রটি মাথার উপর থেকে সোনালী আলো ছড়াচ্ছে। সঙ্গে তারাগুলি সৌন্দর্যময় করে তুলেছে গ্রামের নিঝুম রাতের আকাশটিকে। নয়ন ধীরেধীরে সেই জায়গায় হেটে যাচ্ছে যেখানে রোজ মিন্টু আল-আমিন আর আছাদ মাঝেমধ্যে মন্জুদের সাথে অনেকক্ষণ সময় কাটায় গানে গানে। নয়নের আজ গলা ছেড়ে গান গাইতে মন চাইছে। সেখানে এসে দেখে দুই জন বসে আছে। আল-আমিন আর আছাদ চলে গেছে। মিন্টু আর মন্জুকে পেয়ে ভালই লাগলো। কিরে, তোরা আছস নাকি। হেরা দুই জন চলে গেছে।
হুম, কখন গেছে তারা। মনে হয়ে ঘুমিয়েও পড়েছে এতক্ষণে। তুই আজ এত দেরি করলি যে। মন্জু বলছিল আমাকে দেখেই। আমি বললাম একটু কাজ ছিল, তাই দেরি হয়ে গেল। মিন্টু বলছে, বোঝতে পারছি তোর দেরির কারণ, যেতে চেয়েছিলাম তোর ঘরে, কিন্তু পরে আর না গিয়ে এখানে এসে বসে পড়লাম। ভাবছি তুই আসবি, তাই এখনো থেকেই গেলাম।
ভালো করেছিস। আমিও আসতেই চেয়েছিলাম তাড়াতাড়িই কিন্তু দেরি হয়ে গেল, একটা চিঠি লিখতেই।
হুম বোঝেছি। মিন্টু বললো।
আজ তাইলে একটা গান হয়ে যাক। মন্জু খুব উচ্ছসিত হয়েই বললো। মন্জুও গান গাইতে শিখে গেছে আমার সাথে থাকতে থাকতে। আমি বললাম, তুই শুরুকরে দে, আমি ধরবো সাথে।
মন্জু আর মিন্টু দুজনেই টান দিল একটা ছায়াছবির গান। আমারও খুবই প্রিয় গানটি। আমিও তাদের সাথে সুর ধরলাম।
কি যাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা, 
থাকিতে পারিনা ঘরেতে প্রাণ সজনী
থাকিতে পারিনা ঘরেতে......
গান শেষ হতেই- বাহ! বাহ! চমৎকার গানটিই ধরছস রে মন্জু। আমারও এখন যে তেমনই অবস্থা। আরও কয়েকটা গান গেয়ে আমি বললাম আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে। তাই এখন চল ওঠি। মিন্টু বলছে তাড়াতাড়ি করতে হবে না, এমনিতেই একটা পার হয়ে গেছে।
হুম, আমিই তো এসেছি প্রায় বারোটার দিকে। এখন একটা পার হতেই পারে। চল ওঠি বলে আমি ওঠে বাড়ির দিকে হাটছি। আমাদের বাড়ির সামনে থেকে মন্জু চলে গেল তাদেরে বাড়ির দিকে, মিন্টু আমাদের বাড়ি পার হয়ে যাবে। মিন্টুকে বললাম কাল একটু সকাল সকাল স্কুলে যেতে হবে, বলেই বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলাম। রুমে ঢুকে মিনতির ছবিটা দেখলাম কুপি জ্বালিয়ে বেশকিছুক্ষণ। মনে মনে অনেক স্বপ্ন কথাই এঁকে ফেললাম আগামীকালের কথা মনে করে। বাতি নিভিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে যাই হয়তো....।

সকালে ন'টার মধ্যে গোসল করে খাওয়া দাওয়া সেরে বই নিয়ে সাড়ে ন'টার মধ্যেই স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। দশ মিনিটেই স্কুলে পৌঁছে বইগুলি রেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। বারবার হাতের ঘরিটি দেখছি। মনে মনে কখন আসবে মিনতি। দশটার একটু আগেই মিনতিকে দেখে আমার অস্থিরতা কিছুটা কমলো। মিনতি সবসময়ই সাদামাঠা সাজগোজ করে স্কুলে আসতো, আজ একটু অন্যরকম চকচকানো মনে হচ্ছে। খুব সুন্দর লাগছে। আমি অপলক চেয়ে আছি তার দিকে। তার হাটার তালে তালে আমার মন নাচতে চাইছে। আমি মুগ্ধ হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছি। মিনতি কাছাকাছি এসে পড়েছে। কমনরুমে বই রেখে আমার ক্লাসে এসে হাজির। বস মিনতি, আজ একটু সময়।
না না, বসা যাবেনা, তুমি আমার চিঠি দাও।
তোমার চিঠি মানে! তোমার চিঠি ফেরত নিবা?
আরে না বোকারাম, আমাকে দিতে যে চিঠি এনেছো সেটা দাও।
ও ও তাই বলো, আমি তো আরও ভাবছিলাম তোমারটাই ফেরত চাইছো।
হুম, তুমি তো ভাববাই। দাও তো এখন, দেরি করো না।
এত তাড়াতাড়ি কেন কর বলো তো? আমার সাথে কি একটুও থাকতে মন চায় না তোমার। আমি একটু মন খারাপ করার মতোই বললাম। মিনতি বারবার দূর পথের দিকে তাকাচ্ছে। আমি একটু রাগ হয়েই বললাম দমকের সুরে - কি দেখছো উঁকি দিয়ে, এত ভয় কিসের তোমার? আমার রাগ বোঝতে পেরে মিনতি একটু দমে যাওয়ার মতো স্থির হয়ে নিচু স্বরে বলছে-
আরে না, ভয় না তেমন, তাছাড়া আমি আসার সময় দেখে আসছি আমাদের গ্রামের আরও ছাত্রিরা আসছে স্কুলে। আমি তাদের ছাড়িয়ে একটু তাড়াতাড়ি এসেছি। তারা এসে গেলে সব জেনে যেতে পারে।
জানলে কি হবে?
কি হবে তুমি কি বোঝবা। একটু গম্ভীর হয়ে কথাটা বলে মিনতি চুপ হয়ে আছে। মিনতির এমন চুপ হয়ে যাওয়া গম্ভীর মুখ দেখে নয়নের বুকের ভেতরটা কেমন যেনো মুচড়ে ওঠছে। নয়নেরও কষ্ট অনুভব হচ্ছে। নয়ন মিনতির দিকে চেয়ে আছে অপলক। চোখ দিয়ে যেনো অশ্রু এখনই গড়িয়ে পড়বে। মিনতি তা দেখেই মুচকি হাসি দিয়ে-
দেখো, তোমার এগুলো ভাবতে হবে না। আমার আম্মাকে দারুণ ভয় পাই আমি। গ্রামের অন্য কেউ দেখলে যদি আম্মার কানে কিছু জানায় তো আর নিস্তার নেই আমার। নয়ন মিনতির মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ শ্রোতার মতো শুনে যাচ্ছে। মিনতি হঠাৎ দমকের সুরেই বলছে- কই, দেও, ছবিও বের করো।
নয়নের যেনো ঘোর কেটে গেল, ও হ্যা, আমার কোন ছবি নাই বর্তমানে পরে দিতে হবে। চিঠিটি বের করে মিনতির হাতে দিলাম।
ছবি পরে মানে, কোন ছবিই নেই! চিঠি নিতে নিতে মিনতি অবাক হয়েই বললো।
না, মানে, হাফ সাদাকালো আছে।
সেটাই নিয়ে আসলানা কেন? মিনতির মুখটা ভার মনে হলো। 
আচ্ছা কাল নিয়ে আসবো। আর মুখ ভার করতে হবে না। পরে একদিন আরও ছবি দেবো এনে। এবার একটু হাসো।
মিনতি এবার হাসি মুখে তার বুকের ভেতর থেকে আরেকটা চিঠি বের করে আমাকে দিতে দিতে বলছে-
গতকাল সবকথা লিখতে পারিনি। আজ মোটামুটি লেখেছি। এটা পড়ে কালকেই উত্তর নিয়ে আসবা, ভুল যেন না হয়।
নয়নের মনটা অজানা সুখে ভরে উঠলো নতুন চিঠি পেয়ে। চিঠি পকেটে রেখে, তোমাকে খুব মনে পড়ে মিনতি। আমারও... বলে মুচকি হেসে বেরিয়ে পড়লো কমনরুমের দিকে হাটছে। নয়ন মুগ্ধ নয়নের মিনতির হেটে যাওয়া দেখছে পিছন থেকে।

এভাবেই চলতে থাকলো প্রায় রোজই একটা করে নতুন চিঠি। বড় জোর একদিন পার হতেই আবারও নতুন চিঠি। খুব জমে ওঠলো দুজনের চিঠি আদানপ্রদান। দিন পার হচ্ছে, চিঠির পর চিঠি জমছে। মনের কথাগুলো সব কাগজের গায়ে চাপিয়ে জানানো হচ্ছে। প্রতিদিনের স্বপ্ন অাশা মনের না বলা কথাগুলো এভাবেই বলে চলেছে দিনের পর দিন। সামনাসামনি কিছুই বলার সুযোগ নেই, সুযোগ থাকলেও হয় না বলা। চিঠির পাতায় বলেই শেষ করা হচ্ছে মনের যতো জমানো কথা। ভালোই হাসিখুশি চলছে তাদের স্কুল জীবন। কোনো চিন্তাভাবনা নেই যেনো আর..... একদিন না দেখলে চলবে না যেনো কারোরই। প্রতিদিন স্কুলে আসতেই হবে, দেখতেই হবে প্রিয় মুখটি। চলছিলও তাই......

হঠাৎ বেশ কয়েকদিন স্কুলে আসছে না মিনতি। নয়নের মুখে এখন আর হাসি নেই সারাক্ষণ এক বেদনার প্রতিচ্ছবি। কোন কাজে মন নেই। পড়া লেখাও হচ্ছে না তেমন। মিনতি কোথায়, কেমন আছে সেই চিন্তাই মনে সারাক্ষণ। ভালো মন্দ কত অজানা ভাবনায় ডুবে আছে নয়ন। যে নয়ন সারাক্ষণ মুখে গান গাইতো গুনগুন করে, সেই নয়ন এখন চুপচাপ বসে থাকে শুধু। কারো সাথে কথা নেই, মুখে গান নেই, কেমন একটা বিষণ্ণতা ছেয়ে আছে তাকে। সঙ্গী সাথী ক্লাসমেট, বন্ধু সবার মনে একটাই ভাবনা কি হলো নয়নের। কেন নয়ন আগের মতো উচ্ছল নয়, চঞ্চলতা হারিয়ে চুপচাপ। ক্লাসে আগের মতো তেমন চঞ্চল দেখা যায়না নয়নকে। খালেদার নজরে পড়তে দেরি হলো না নয়নের এমন অবস্থা। কোনোকোনো বান্ধবীর খোঁচা মারা কথা কোন কিছুই আর নয়নকে সরব করে তুলতে পারছে। খালেদা একসময় সেই টিউবয়েল পারে নয়নকে পেয়েই দাঁড়াতে বলছে, দাঁড়াও নয়ন।
হ্যা বল,
তোমার মনটা খুব খারাপ যাচ্ছে কয়েকদিন। আমি বুঝেছি তোমার কষ্টগুলো। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমিও জানিনা মিনতি কেন স্কুলে আসছে না। কিছু বলেও নি আমাকে।
হ্যা খালেদা, আমার চিন্তার কারণ তুমি ধরেছো। আমি কেমনে থাকি বলতে পারো! যাকে প্রতিদিন দেখি, তাকে আজ কয়েকদিন দেখতেই পারিনা। তারচেয়েও বড় কষ্টের জানিই না সে কোথায়! কি কারণে আসছে না স্কুলে।
হ্যা ঠিকই বলেছো তুমি। আমি দেখি আজ তাদের বাড়ির পাশের একজনকে মিনতি সম্পর্কে জানতে চাইবো। তুমি ভেঙে পড়ো না। তুমি একটু সরব থাকো আগের মতো।
নয়ন বেশ খেয়াল করেছে, খালেদা তাকে ভাইয়ের মতোই স্নেহ ভালোবাসা দেখায় সবসময়। অন্যান্য ক্লাসমেটের চেয়ে খালেদার আন্তরিকতাও বেশি নয়নের প্রতি। সম্পূর্ণ বিবেকবান একটা মেয়ে খালেদা। খালেদার এমন মায়া ভরা কথায় নয়নের চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করে দিয়েছে দেখে তাড়াতাড়ি টিউবয়েল চেপে পানি দিয়ে মুখটা ধোঁয়ে নিল নয়ন। খালেদার চোখ এই সামান্য অশ্রুটুকুও এড়িয়ে যেতে পারেনি। খালেদা যাওয়ার সময় বলছে, নয়ন মনে সাহস রাখো, তার সাথে আগে আমার সব কথাই হয়েছে তোমার সম্পর্কে। মিনতি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসে। তুমি শুধু এটুকুই মনে রেখো। এইটুকু বলে খালেদা চলে গেল। নয়ন গার কাত করে সম্মতি জানিয়ে খালেদাকে বিদায় জানিয়ে আবারও মুখটা ধোয়ে ক্লাসে চলে এলো। 

আমীর আলী নয়নকে দেখে বোঝতে পেরে বলছে, নয়ন সাব আপনার চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আপনি কাঁদছেন। আমি আপনাকে সেসব বলবো না। আমি বলতে চাইছি আপনি সবসময় আগের মতোই হাসিখুশি থাকুন। আপনার জিনিষ আপনারই থাকবে, যেখানেই তা থাকুক।
বুঝেছি অামীর সাব, তবুও কেন যেন মন মানতে চায় না। বারবার ঘুরেফিরে তার কথাই ভাবে। নয়ন একটু সহজ হতে চাইছে।

স্কুল ছুটি হলে প্রতিদিনকার মতো নয়ন বাড়ির দিকে হাটছে। মিন্টু দূর থেকে ঢাকছে দেখে দাঁড়ালো একটু। মিন্টু এসেই পিঠে হাত রেখে হাটছে আর বলছে- তোর কয়েকদিনের চিন্তাভাবনা আমাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। আমি বোঝে গেছি তুই কষ্টে আছস। তাই তোকে না জানিয়েই আমি একটা তদন্ত চালিয়েছিলাম তোকে খুশি করবো বলে।
কি তদন্ত ?
কি তদন্ত তা তুই বুঝছস। তবুও বলি, তোর মিনতির খবর।
মুহূর্তেই নয়নের মধ্যে অন্যরকম চঞ্চলতা ফিরে এলো যেনো। অতি উৎসাহি হয়ে মিন্টুকে বলছে- একটু বল না, শুনে একটু শান্তি পাবো। বল না, বল, মিনতি কই?
নয়নের মিনতি ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আর বনিতা করতে পারলো না মিন্টু। সোজাসুজি বলে দিল, মিনতি আপা তার নানি বাড়ি বেড়াতে গেছে আজ তিনদিন হল।
তুই কেমনে জানলি ?
কেমনে জেনেছি সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে তোর জন্য একটা স্বস্তিকর খবর আনতে পারলাম কি না বল?
হ্যা, হ্যা, অবশ্যই স্বস্তিকর খবর দিছস দোস্ত। আজকে রাতের আড্ডা খরচ আমার পক্ষ থেকে। দুজন কথা বলতে বলতে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। বাড়ির সামনে এসে মিন্টুকে বললাম, তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে আসবি, বিস্তারিত শুনে পুরোপুরিভাবে চিন্তামুক্ত হতে চাই।
মিন্টু বললো না, এখন না। অনেক আলাপ আছে এই বিষয়ে। রাতে সেখানে বসে সব আলাপ হবে। আমি এখন একটু ক্ষেতে যাবো, কিছু কাজ করতে হবে। ভালো থাকিস। চিন্তার কারণ তেমন নাই.... বলে মিন্টু চলে গেল তার বাড়ির দিকে।
নয়ন তার বাড়িতে ঢুকে পড়লো। মনে একটা চিন্তা রয়েই গেল যেন মিন্টুর শেষ কথায়। চিন্তার কারণ তেমন নাই, তবে কি কোনো চিন্তা আছে ? আবার কেমন যেনো একটা ভাবনা রয়েই গেল মনে..... 

বড় ভুল করেছিলাম তোমায় ভালোবেসে... পর্ব-২

বড় ভুল করেছিলাম তোমায় ভালোবেসে... প্রথম পর্ব 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন