পরম করুণাময় মহান আল্লাহ্'র উপর লাখো কোটি শুকরিয়া রাখছি....
বিপদে পড়লে আমাদের আল্লাহ্'র উপরই ভরসা করতে হয়। তাতেই মুক্তি।
গতরাতে যখন অামাকে বলা হল 'আগামীকাল সকালে আপনাকে খালিয়াজুরি যেতে হবে'। তখনই মনটা খারাপ হয়ে গেল, আমি বলে রাখলাম না, আমি যেতে পারবোনা, অন্য কাউকে দেখেন। প্রতিউত্তর পেলাম, লোক নেই, আপনাকেই যেতে হবে। আমি পারবোনা বলে অফিস থেকে বেরিয়ে এসে রাতের খাবার খাই তখন প্রায় দশটা বাজে। খাচ্ছি আর ভাবছি, সত্যিই তো আর কোন ফ্রি লোক নেই, যেতে তো আমাকে হবেই। মনটা একটু খারাপই হলো।
খাওয়া শেষে পাশের দোকানে বসে ফেসবুকে ঘুরছি। মনে সকালের চিন্তা। না, কষ্টই হয়ে যাবে কাল। চারিদিক ভাসা পানি। যাবো তো নৌকাতে বসে বসেই। কিন্তু ফিরবো কিভাবে! ফিরবোও তো নৌকাতে বসে বসেই। তাহলে তো কষ্ট হওয়ার কথা না। তবুও মনে হচ্ছে কষ্টই হবে। হ্যা, কষ্ট হবে। কারণ, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাকে না খেয়েই থাকতে হবে হয় তো। মাথাটা কেমন যেন ভার মনে হচ্ছে। এগারোটা পর্যন্ত দোকানে বসে থাকার পর আর থাকতে মন চাইলো না। রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছি। ফেসবুক আর ব্লগের নোটিফিকেশন দেখে প্রতিউত্তর গুলো দিয়ে চোখ বোজে শুয়ে রইলাম।
সকালে ঘুম ভাঙলো স্যারের ডাকে। স্যার একশো টাকা আগবাড়িয়ে যখন বললো যানগা, ঘুরে আসেন। আমি আর না করতে পারলাম না। না, টাকার জন্য নয়। একেতো লোক নেই, তারপর স্যারের এই সৌজন্যতা আমাকে না রাখলে সেটা বেয়াদবি হয়ে যাবে। তাই, টাকাটা রেখে বললাম, আচ্ছা রেডি হচ্ছি। স্যার বললো সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে, তাড়াতাড়ি রেডি হন। আমি টয়লেট সেড়ে সেভ হয়ে গোসল করতে যাবো। এমন সময় স্যার ঘাট থেকে এসে বলছে নৌকা ৭.১০ মিঃ এ ছেড়ে যাবে। আমি গোসল করার চিন্তা বাদ দিয়ে ব্রাশ করে হাতমুখ ধোয়ে রেডি হয়ে ঘাটে চলে এলাম। সত্যিই নৌকা যথাসময় ছেড়ে দিল।
নৌকাতে যেতে ভালই লাগছে। হাল্কা বাতাস নৌকার ছাউনিতে বসে ভালই উপভোগ করছি চারপাশের নতুন পানি। টুইটারে একটা আড়াই মিনিটের লাইভ দিলাম ভ্রমণটাকে স্মৃতি হিসেবে রাখতে। ভালোই লাগলো সকালের এই নৌকাপথ। সাড়ে নয়টার দিকে পৌঁছে গেলাম খালিয়াজুরী। আমার কাজ বলতে কাজগ ভরা একটা খাম। অফিশিয়াল কাগজপত্র। খামটা বুঝিয়ে দিলাম আমার কাজ শেষ। তখন প্রায় দশটা বাজে। কিন্তু আরেকটা কাগজ নিয়ে আসতে হবে আমাকে। সেজন্য দেরি করতেই হবে, কারণ, বিদ্যুৎ নাই। বিদ্যুৎ এলে ফটোকপি করে তারপর নিতে হবে। দেরি হবে দেখে পাশের হোটেলে গিয়ে রুটি খেয়ে নিলাম। দুপুরবেলা খাওয়া না'ও হতে পারে তাই স্বাভাবিকের চেয়ে একটা রুটি বেশিই খেয়ে নিলাম ডিম ভাজা আর ডাল দিয়েই।
প্রচণ্ড গরম। রোদেগরমে তিক্ত মানুষ, আমিও। বিদ্যুৎ এর জন্য অপেক্ষা করতে করতে অসহ্য মনে হচ্ছে। স্যারকে ফোন দিলাম। স্যার, বিদ্যুৎ নেই, তাছাড়া শুক্রবার সব দোকান বন্ধ। স্যারের উত্তর, আপনাকে তো দুটো পর্যন্ত নৌকার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। তাই একটু অপেক্ষা করে বিদ্যুৎ আসলে ফটোকপি করে নিয়ে আসেন, কাগজটি লাগবেই। আমি জ্বি স্যার বলে অপেক্ষা করতে লাগলাম বিদ্যুৎ এর জন্য। শেষে বিদ্যুৎ এল তখন বারোটা পার। ফটোকপি করে ঘাটে আসলাম একটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি।
ঘাটে এসে মাথা নষ্ট, কোন নৌকা নেই লেপশিয়া যাওয়ার। সূর্যর তাপ গরম আর নৌকার অপেক্ষা তখন আমার কেমন লাগছে তা না বলাই ভালো। খুব রাগ হচ্ছিল মনে। কিচ্ছু করার নেই, এটাই আমার চাকরির অংশ। আমার জীবনটা যে চাকরিতে বাঁধা।
বসে আছি ঘাটের সাথে দোকানের ছায়ায়। ঘুরছি ব্লগে। একটা নৌকা যাবে বোয়ালি ঘাটে দুটার দিকে। আমাকে বোয়ালি ঘাটে গেলে আবার সেখান থেকে লেপসিয়ার নৌকা ধরতে হবে। তাতে সময় কমকরে হলে সাড়ে তিন ঘন্টা নৌকাতে থাকতে হবে। তারচেয়ে বরং আমাকে ইটনা ফেরত নৌকার জন্যই অপেক্ষা করা ভালো। যে নৌকা দিয়ে সকালে এসেছি। তাই বসে রইলাম সাড়ে তিনটা বাজার অপেক্ষায়। ব্লগে ভালো লাগলো না, খুব রোদ। মোবাইল রেখে দোকান থেকে স্প্রীড কিনে খাচ্ছি আর ভাবছি এই তো আমার ভবঘুরে জীবন। কখন কোথায় কি অবস্থায় তা নিজেও জানিনা।
অনেক তাপদাহ শেষে তিনটার দিকে হঠাৎ রোদ নেই। আকাশে মেঘ জমছে। দূরে কোথাও হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে। ঠাণ্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে দেখছি সামনের হাওড়ে পানির মৃদু নাচন। ইটনা ফেরত নৌকাটাকেও দেখা যাচ্ছে না। সাড়ে তিনটা পার হয়ে গেছে। একটু টেনশন হচ্ছে। আকাশে মেঘ দেখে যদি নৌকা না আসে তবে আমাকে এখানেই থেকে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় দেখছিনা। এর মধ্যে দূরে চোখে পড়লো একটা নৌকা আসছে। সেটাই কিনা ঠিক বুঝতে পারছিনা। একটু পরে বুঝতে পারি হ্যা, এটাই সকালের নৌকা। যাক, আমার দুশ্চিন্তা দূর হলো। নৌকা ঘাটে এসে থামলো।
নৌকায় ওঠে বসে বসে আকাশ দেখছি। কেমন যেন চিন্তা হচ্ছে মনে। পথে যদি কোনরকম বাতাস ওঠে তো কি অবস্থা হবে! তখনও তেমন বাতাস নেই। যদিও মাঝে মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে তবুও তেমন সমস্যা হবে বলে মনে হলো না। নৌকায় মালামাল যা ঘাটে নামানোর ছিল নামিয়ে রেখে নৌকা ছেড়ে দিল। রোদ নেই, হাল্কা ঠাণ্ডা বাতাস, ভালই লাগছে। বসে বসে পানি দেখছি চোখ যতদূর যায়।
কিছুক্ষণ নৌকা চলার পর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু। সঙ্গে কাগজ মোবাইল ভিজবে ভেবে নৌকার ভিতরে ঢোকলাম। মুহূর্তের মধ্যে প্রচণ্ড শব্দ করে বিজলি চমকানো শুরু সঙ্গে বিষণ বৃষ্টি আর বাতাস। নৌকার ভেতর যাত্রী আর নৌকার চালক কর্মী মিলে মাত্র পঁচিশ থেকে ত্রিশ জনের মতো। নৌকার দোল দেখে মনে ভীষণ চিন্তা। মনে মনে 'লা ইলাহ ইন্না আন্তা ছোবহানাকা ইন্তি কুন্তু মিনায যোঁয়ালেমিন' পড়ছি। কতবার পড়ছি তার হিসেব নেই। উপরের ছাউনির কাঠ ধরে আছি। ভিতরে ছোট বাচ্চাসহ এক মায়ের কান্না। আমরা শান্তনা দিচ্ছি, সাহস দিচ্ছি। আল্লাহ্ ভরসা, কিচ্ছু হবে না। মনে মনে তো আমার সেই লা ইলাহ চলছেই। নৌকা উল্টার চিন্তা। প্রচণ্ড বাতাস। নৌকা দোলছে রীতিমতো। সবার বুকেই ভয়। এভাবেই প্রায় বিশ মিনিট। এর মধ্যে চালক নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছে। নৌকা নিজে নিজেই দোলছে আর চলছে ভাটির দিকে। তারপর শুরু পুরোদমে শিলাবৃষ্টি। বাতাস কমে গেছে। নৌকা এখন আর তেমন দোলছে না। সবার মনে স্বস্তি দেখা দিয়েছে। আল্লাহ্ এভাবের মতো ক্ষমা করলেন হয়তো.....
সারাদিন আল্লাহ্'র কথা স্মরণ যদিও হয়, কিন্তু এত মমতায় কখনো ডাকা হয় না। যখন কোন অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ সামনে আসে, তখন আল্লাহ্ ছাড়া কেউ থাকেনা মনে। এর জন্যই আমি স্বার্থপর। আমি বিপদেআপদে আল্লাহ্'কে স্মরণ করি কিন্তু সেভাবে স্বাভাবিক সময়ে স্মরণ করিনা।
কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা আর হঠাৎ মৃত্যুভয়ে আজকের দিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকুক আমার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন